রাজ্যসভার মতো লোকসভাতেও সীমান্ত বিল পাস হয়ে গেল সর্বসম্মতিতে। গতকাল বৃহস্পতিবার তিন ঘণ্টা বিতর্কের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ অনুরোধ করেন, দেশের স্বার্থে সবাই যেন রাজ্যসভার মতোই এই বিলের পক্ষে ভোট দেন। সেই অনুরোধ অনুযায়ী ৩৩১ ভোটে পাস হয়ে গেল দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এই বিল। সংবিধান সংশোধন বিলের ক্ষেত্রে দেশের ৫০ শতাংশ রাজ্য বিধানসভার সমর্থন প্রয়োজন। তা আদায় হলেই বিলটি বাস্তবায়িত হবে।
রাজ্যসভার সঙ্গে লোকসভার পার্থক্য ছিল দুটি ক্ষেত্রে। রাজ্যসভায় কোনো রাজনৈতিক দলই এই বিলের বিরোধিতা করেনি। কিন্তু গতকাল লোকসভায় আসামের রাজনৈতিক দল অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এআইইউডিএফ) এই বিলের বিরোধিতা করে। তিন সদস্যবিশিষ্ট এই দলের নেতা সিরাজুদ্দিন আজমল বলেন, এই বিল বাস্তবায়িত হলে আসামের বিন্দুমাত্র উপকার হবে না। রাজ্যের প্রচুর জমি বাংলাদেশ পেয়ে যাবে। তিনি বিলটি প্রত্যাহারের দাবি জানান। তাঁর বক্তব্যের জবাবে সুষমা স্বরাজ বলেন, বিল প্রত্যাহারের সম্ভাবনা নেই। দেশের স্বার্থে এই বিল। সিরাজুদ্দিনদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা আপনাদের বক্তব্য পেশ করেছেন। তা রেকর্ডেও থাকল। তাই অনুরোধ, আপনারা বিলের বিরুদ্ধে ভোট দেবেন না। আমরা যে রাজনীতির ঊর্ধ্বেও উঠতে পারি, গোটা পৃথিবীকে তা দেখানো দরকার।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুরোধ মেনে তাঁরা বিলের পক্ষেই ভোট দেন।
এটা যদি হয় প্রথম পার্থক্য, দ্বিতীয়টি তাহলে আসামের কংগ্রেস ও বিজেপি সদস্যদের মধ্যে বাদানুবাদ। বিজেপির রাজেন গোঁসাই ও আর পি শর্মার সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন কংগ্রেসের গৌরব গগৈ ও সুস্মিতা দেব। বিজেপির সদস্যদের দাবি, এর ফলে আসামের যতটুকু ক্ষতি, তার জন্য দায়ী কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ। কংগ্রেস সদস্যরা পাল্টা দাবি জানান, এই বিল কার্যকর হলে আসামের বাড়তি জমি লাভ হবে। অপদখল ও সীমান্ত চিহ্নিতকরণের ফলে আসামের যে বাড়তি জমি লাভ হবে, সে কথা সুষমা নিজেও স্বীকার করে নেন। এই দুটি ঘটনা ছাড়া লোকসভার তিন ঘণ্টার বিতর্ক ছিল আবেগ ও বন্ধুতার মোড়কে ঢাকা, যা এই দুই দেশের ভবিষ্যতের সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলোর পক্ষে সহায়ক হবে বলে সবার আশা।
বিল নিয়ে ভোটাভুটির সময় কিছুটা কৌতুকেরও সৃষ্টি হয়। ইলেকট্রনিক ভোটিং ব্যবস্থার ত্রুটিতে দেখা যায়, গোটা কক্ষের সবাই সবুজ বোতাম টিপলেও খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভোট পড়েছে বিলের বিরুদ্ধে এবং প্রধানমন্ত্রীর ভোটই পড়েনি। এ নিয়ে হাসাহাসি শুরু হয়। স্লিপ দিয়ে এই ত্রুটি সংশোধন করা হয়।
কংগ্রেসের পশ্চিমবঙ্গের সদস্য অধীর চৌধুরীসহ কয়েকজন পুনর্বাসনের বিষয়ে সরকারকে সজাগ থাকার পরামর্শ দেন। তাঁরা বলেন, লোক বিনিময়ের ফলে যাঁরা ভারতের নাগরিক হবেন, তাঁদের যাবতীয় নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য যেন নিশ্চিত করা হয়। সুষমা এর জবাবে বলেন, সেই দায়িত্ব রাজ্য সরকারগুলোর। কেন্দ্র পুরো অর্থ সাহায্য করবে। পশ্চিমবঙ্গের জন্য এই সাহায্যের পরিমাণ ৩ হাজার ৯ কোটি রুপি। এর মধ্যে অবকাঠামো তৈরিতে খরচ হবে ৭৭৫ কোটি, বাকি ২ হাজার ২৩৪ কোটি রাখা হচ্ছে যত মানুষ আসবেন তাঁদের জন্য। এই নাগরিকদের ভোটার কার্ড দেওয়া, ব্যাংক হিসাব খোলা, রেশন কার্ড দেওয়ার দায় রাজ্য সরকারদের।
বিজেপির রাজেন্দ্র গোঁসাই, রবীন্দ্র জেনা ও শিব সেনার বিনায়ক রাউত অনুপ্রবেশ সমস্যার সমাধানে সরকারকে উদ্যোগী হতে বলেন। রাজেন্দ্র গোঁসাই বলেন, গোটা আসামই বাংলাদেশের ছিটমহল হয়ে গেছে। অনুপ্রবেশকারীরা এই রাজ্যকে এক চরম সমস্যার মুখে দাঁড় করিয়েছে। একই অভিযোগ রবীন্দ্র জেনা ও বিনায়কের। তাঁরা বলেন, বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারীরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণ। বিশেষ করে মহারাষ্ট্রে। তাঁদের সম্মিলিত দাবি, এই চুক্তির পর সরকার যেন বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলে অনুপ্রবেশকারীদের ফেরত নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে। সুষমা অবশ্য এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি বারবার বলেন, এই বিল পাস হলে দুই দেশের সম্পর্ক সেই ’৭১ সালে যেমন ছিল, তেমনই হয়ে যাবে। ট্রানজিট, বাণিজ্য, নদীর পানিবণ্টন, বিদ্যুৎ, নিরাপত্তা বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা অনেক বেড়ে যাবে। প্রকৃত সৌভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুতার নিদর্শন রাখতে পারবে এই দুই দেশ, যা দুজনকেই এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
বিজেপির পক্ষ থেকে বিতর্ক শুরু করেন পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং থেকে নির্বাচিত সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়া। তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নানা স্মৃতি উঠে আসে। আবেগ তাঁর কণ্ঠ রুদ্ধ করে তোলে, যখন তিনি তরুণ কংগ্রেসকর্মী হিসেবে শরণার্থী শিবির খোলার কথা বলেন। কিংবা তৃণমূল কংগ্রেসের সুগত বসু। চিকিৎসক বাবার সঙ্গে বনগাঁ সীমান্তে শরণার্থী শিবিরে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার কথা উল্লেখ করতে করতে তিনিও আবেগঘন হয়ে পড়েন। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের খোলা আকাশের নিচে অস্ত্রোপচারের কাহিনি বলতে গিয়ে তিনি বলেন, স্যালাইনের জায়গায় ডাবের জল দেওয়া হচ্ছে, অজ্ঞান না করিয়ে চিকিৎসা হচ্ছে অথচ মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল তুঙ্গে। সুগত বলেন, এই বিলে সবার স্বার্থ দেখা হয়েছে। রাজ্যের স্বার্থ, দেশের স্বার্থ এবং মানুষের স্বার্থ।
সিপিএমের মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘আমরা সংঘাতের জন্য অনেক খেসারত দিয়েছি, এবার সহযোগিতার ফসল আমাদের ঘরে তুলতে হবে।’ সুগত ও সেলিম দুজনেই স্থায়ী কমিটির সদস্য, যে কমিটি রেকর্ড সময়ে সর্বসম্মতিতে তাঁদের সুপারিশ জমা দিয়েছিল। তাঁরা বলেন, এই বিল সহযোগিতার একটা উদাহরণ হয়ে থাকল। প্রত্যেকের কথায় বারবার চলে আসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, অন্নদাশঙ্কর রায়, জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মনমোহন সিং, শেখ হাসিনা, নরেন্দ্র মোদি, সুষমা স্বরাজের নাম। উঠে আসে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও ভূপেন হাজারিকার গান, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। রাজনীতি ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে আবেগ এবং এক জাতি এক প্রাণ একতার ছবি। ইনসানিয়াতের কথা। বিল পাসের পরই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আসন ছেড়ে এগিয়ে যান সোনিয়া গান্ধীর কাছে। তারপর একে একে সব বিরোধী নেতাকে অভিনন্দন জানান।
সুষমাসহ প্রায় সবাই এই বিলকে ঐতিহাসিক আখ্যা দিয়েছেন। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী থাকেন সস্ত্রীক বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীসহ পদস্থ কর্মকর্তারা। বিল পাসের পর সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী বলেন, ‘এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী থাকতে পেরে নিজেকে ধন্য লাগছে। বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধীর স্বপ্ন আজ পূর্ণ হলো। আমরা অভিভূত।’
পরে স্থানীয় কালিরহাট বাজার থেকে আনন্দ মিছিল বের হয়। ঘণ্টাব্যাপী চলে এই উৎসব। উৎসবে যোগ দেওয়া কৃষক হাবিবুর রহমান (৫৫) প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেন, ‘এখন আর কেউ ছিটের মানুষ বলতে পারবে না। আমরা বাংলাদেশি।’
লোকসভায় বৃহস্পতিবারই বিলটি পাস হতে পারে—এ খবরে উৎসব করার জন্য মঞ্চ তৈরি করে বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির দাশিয়ারছড়া ইউনিট। মিছিল শেষে আলতাফ হোসেনের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক জাফর আলী।
ছিটমহলের বাসিন্দারা জানান, দীর্ঘদিন থেকে ছিটে দুটি গ্রুপ সক্রিয় ছিল। একটি ছিটমহল ইউনাইটেড কাউন্সিল অন্যটি বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি। ইউনাইটেড ভারতের নাগরিকত্ব চেয়েছিল। এখন সীমান্ত বিল লোকসভায় পাস হওয়ায় ইউনাইটেড কাউন্সিলের লোকজন হুমকির মুখে আছেন বলে অভিযোগ করেন কাউন্সিলের দাশিয়ারছড়া ছিটের সভাপতি মিজানুর রহমান।
ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবাইকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছি। আশা করি অপ্রীতিকর পরিস্থিতি হবে না।’ বিকেলে ছিটমহলে দেখা হয় কুড়িগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জানান, ছিটের শান্তি বজায় রাখতে পুলিশ পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে।
(কৃতজ্ঞতায়- প্রআ)
কোন মন্তব্য নেই। আপনি প্রথম মন্তব্যটি করুন। on লোকসভায়ও সীমান্ত বিল পাস সর্বসম্মতভাবে