২০ জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , সোমবার, ৬ মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৯ রজব, ১৪৪৬ হিজরি।
২০ জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , সোমবার, ৬ মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৯ রজব, ১৪৪৬ হিজরি।

আলহাজ্ব নাসির আহমদ: কমিউনিটির আদ্যোপান্ত এক দরদী নেতা

।।মোহাম্মদ মারুফ।।

আলহাজ্ব নাসির আহমেদ চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তিনি জানুয়ারী ২০২৪ এ বাংলাদেশে গিয়ে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৫ মার্চ ২০২৪ বাংলাদেশ সময় ভোর রাত চারটার সময় ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

#

আলহাজ্ব নাসির আহমদ। কমিউনিটির আদ্যোপান্ত এক দরদী নেতা। যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বার্মিংহামের বাঙালী কমিউনিটিকে ভাবা হত অবহেলিত। যাদের প্রচেষ্টায় বাঙালী কমিউনিটি আজ মুলধারায় শক্ত অবস্থান নিয়ে আছে তাদের মধ্যে আলহাজ্ব নাসির আহমেদ এর ভূমিকা স্বার্ণাক্ষরে ইতিহাসে লেখা থাকবে।

একজন সংবাদকর্মী হিসেবে তাঁর সাথে আমার অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। আমার প্রতি তাঁর ভালবাসা-স্নেহের প্রমাণ পাই যখন বাংলা প্রেসক্লাব, বার্মিংহাম মিডল্যান্ডস এর অভিষেক অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে তাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য সাক্ষাত করি। তিনি তখন খুবই খোলামেলা ভাবে বার্মিংহামের কমিউনিটি বিষয়ে কথা বলেন। বিভিন্ন দ্বন্ধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বলেন জীবনের শেষ সময়ে এগুলো নিরসন হোক চাই। এরপরই তিনি সাংবাদিকদের মধ্যে বিভেদ নিয়ে কথা বলেন। কমিউনিটি বিষয়ে দীর্ঘ দু ঘন্টা কথা বলার পর যখন সাংবাদিকদের বিভেদ প্রসঙ্গ তুলেন। তখন আমার আর বুঝতে বাকি থাকে না যে আমাকে তিনি সরাসরি এ প্রসঙ্গে কথা বলতে ইতস্তত বোধ করছেন। এটা আমার প্রতি তার স্নেহ ও ভালবাসা ছাড়া আর কী হতে পারে। তৎক্ষণাত আমি তাকে বলি আপনি মুরব্বী। কমিউনিটির বিরোধ-বিভেদ প্রসঙ্গে আজ আর কিছু বলছি না। কখনো প্রয়োজন মনে করলে আমাকে পাবেন আপনার পাশে। তবে আমি সাংবাদিকদের বিরোধ নিয়ে আমার বা আমাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করছি। তখন তিনি আমার পুরো কথা অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে শুনেন এবং বলেন- আপনার সাথে কথা বলে আমার ভুল ভাঙলো।

১৯৫৭ সালে যুক্তরাজ্যে আসার পর থেকেই বার্মিংহামে বসবাস করছেন আলহাজ্ব নাসির আহমেদ। ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি শুরু থেকেই প্রবীণদের সাথে কমিউনিটির উন্নয়ণে বিভিন্ন সংগঠনে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন।

সম্প্রতি ডিসেম্বর ২০২৩ এর শেষ দিকে বাংলাদেশে যাওয়ার পূর্বে তাঁর সাথে কমিউনিটির বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপচারিতায় তিনি বলেন- ১৯৬২ সালে পুরো যুক্তরাজ্যে ৩৩টি সংগঠনের সমন্বয়ে যে পাকিস্তান ফেডারেশন সক্রিয়া ছিল। সেই সংগঠনে বার্মিংহামের পাঁচটি সংগঠন সংযুক্ত ছিল। এই পাঁচ সংগঠনের অন্যতম ছিল আজিজ মেমোরিয়াল ক্লাব। তিনি এই সংগঠনের সেক্রেটারী হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। এই ফেডারেশন স্বৈরাচার আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখে।

এ সময় তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্রবাসীদের ভূমিকার কথা,  ১৯৬৯ সালে ডিগবাথ হলে বঙ্গবন্ধুর অনুষ্ঠানে প্রবাসীদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়াসহ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত বার্মিংহামের মুরব্বীদের অবদানের কথা আলোকপাত করেন।  এগুলো বিস্মৃতির অতলে ক্রম হারিয়ে যাওয়ার কথা আফসোসের সাথে তিনি তুলে ধরেন। এসময় তিনি অবেগাপ্লুত হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিলেন বারবার। প্রকৃত দরদী একজন নেতা এবং মুরব্বীদের প্রতি বিনম্র ভালবাসা-শ্রদ্ধার ব্যতিক্রমি এক নিদর্শন হিসেবে তাঁকে পেয়েছি তাঁর সাথে সর্বশেষ এ সাক্ষাতে।

বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ কাউন্সিল ও বাংলাদেশ মাল্টিপার্পাস সেন্টার এর মাধ্যমে মুলধারার সাথে দেন-দরবার করে কমিউনিটির উন্নয়ণে একজন বলিষ্ঠ ও অপ্রতিদ্বন্ধি নেতা হিসেবে স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করেছেন নাসির আহমেদ। তিনি গ্রেটার সিলেট কাউন্সিলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং আজীবন যুক্তরাজ্যের পেট্রন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি দীর্ঘদিন যাবত প্রতি বছরই বার্মিংহামের প্রবীণদের স্মরণে স্মরণসভা এবং দোয়া মাহফিলের আয়োজন করতেন।

যুক্তরাজ্যের লন্ডন, ওল্ডহাম, লুটনসহ বিভিন্ন শহরে শহীদ মিনার থাকলেও বার্মিংহামে ছিল না। এ নিয়ে নানা তৎপরতা-উদ্যোগ ছিল কিন্তু দুঃখজনক হলেও তা বাস্তবে রূপ পায় নি। বিভিন্ন পার্কে স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের নামে বাঙালী কমিউনিটি এক ঘৃণ্য রাজনীতির আবর্তে ঘুর্ণমান ছিল। এমতাবস্থায় একটি সাহসী উদ্যোগ-সিদ্ধান্ত নেন আলহাজ্ব নাসির আহমদ। তিনি বাংলাদেশ মাল্টি পার্পাস এর নিজস্ব জায়গায় স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করে সেখানে প্রতিবছর বাংলাদেশের মহান ভাষা শহীদদের স্মরণের ব্যবস্থা করেন। শহীদ মিনার নির্মাণের তাঁর উদ্যোগ বাঙালী কমিউনিটিতে বেশ প্রশংসা পায়।

আলহাজ্ব নাসির আহমেদ প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন এটা একসময় তিনি বলেতেন না। প্রবাসের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরাও এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দেন নি। বিশেষ করে ২০১০ সালে ২৮ মার্চ উদযাপন পরিষদ গঠনের পর, চ্যানেল আই-এর উদ্যোগে ২০১১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের আনুষ্ঠানিকভাবে প্রায় ৪০ জনকে সম্মাননা প্রদানের প্রাক্কালেও তিনি সংগঠকের দাবি করেন নি। কিন্তু সম্প্রতি বছর দুয়েক যাবত তিনি নিজেকে সংগঠক হিসেবে দাবি করতেন। হঠাৎ করে এ দাবী তিনি কেন করতেন তা অজানা রয়ে গেলেও বার্মিংহামের কমিউনিটিরাজনীতি, বিবদমান কোন দ্বন্ধে স্বার্থান্বেষীদের স্বার্থ হাসিলে কারো প্ররোচণা-ইন্ধন ছিল কি না তা খতিয়ে দেখার বিষয়, অনুসন্ধানের বিষয়। তবে এতে তিনি যে ক্রীড়নক হয়েছেন, ব্যবহৃত হয়েছেন তা ভাবার যথেষ্ট খোরাক-উপাত্ত রয়েছে আমাদের কাছে।

উল্লেখ্য বার্মিংহামে আলহাজ্ব নাসির আহমেদ এর ছিল সামাজিক তৎপরতার এক বর্ণাঢ্য ইতিহাস। কমিউনিটির কল্যাণে তাঁর ভাবনা-চিন্তা এবং সাহসিকতা-বিচক্ষণতার সাথে তাঁর নেয়া নানা ভূমিকা-সিদ্ধান্তই তাঁকে মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট। ইতিহাস তাঁকে বার্মিংহামের সফল কমিউনিটি ব্যক্তিত্বের কাতারে স্থান দিবে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

আলহাজ্ব নাসির আহমদ জীবনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে নিঃস্বার্থভাবে দেশের জন্য কাজ করা মুরব্বীদের অবদানের স্বীকৃতি এবং বর্তমানে বেঁচে থাকা প্রবাসী মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের স্বীকৃতি চাইতেন অতিদ্রুত। তাই শারিরীক দূর্বলতা ও বয়োভারে ন্যুজ অবস্থায়ও তিনি ইতিহাসের সাক্ষী হতে ২৮ মার্চ ১৯৭১ এর শপথ দিবস ও প্রথম পতাকা উত্তোলন দিবস এবং প্রবাসী সংগঠকদের স্বীকৃতি আদায়ে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আনতে জানুয়ারী ২০২৪ এ তিনি বাংলাদেশে যান। বাংলাদেশে যাওয়ার পূর্বে বার্মিংহামের প্রবীণ কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব হিসেবে বার্মিংহামের সহকারী হাইকমিশনারের নিকট স্মারকলিপি প্রদান করেন। বাংলাদেশে গিয়ে কতটুকু কী করতে পেরেছেন আমরা জানি না, কারণ দেশে যাওয়ার পরপরই তিনি অসুস্থ হয়ে যান। তবে তার প্রয়াস-অভিপ্রায় ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ থাকবে এটা আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি।

সংবাদটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন সবার মাঝে

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on print
Print
Share on email
Email
Share on whatsapp
WhatsApp

কোন মন্তব্য নেই। আপনি প্রথম মন্তব্যটি করুন। on আলহাজ্ব নাসির আহমদ: কমিউনিটির আদ্যোপান্ত এক দরদী নেতা

আপনি কি ভাবছেন ? আপনার মতামত লিখুুন।

এই বিভগের আরো সংবাদ

সর্বশেষ