২৮ মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৭ রমজান, ১৪৪৫ হিজরি।
২৮ মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৭ রমজান, ১৪৪৫ হিজরি।

স্থানীয় ভাষায় খুৎবা প্রদান: একটি দালীলিক পর্যালোচনা

 

আরবী ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় খুতবা প্রদান করা বিদ’আত ও মাকরূহে তাহরীমি। কারণ তা রাসূলুল্লাহ (সা.), সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবেতাবেঈন এবং গোটা মুসলিম উম্মাহর সর্বযুগে সর্বসম্মত আমলের পরিপন্থী। জুমু’আর নামাযের আগে নবী করিম (সা.) দুটি খুতবা দিতেন। দুই খুতবার মাঝখানে অল্প সময় বসতেন। (মুসলিম শরীফ, ১/২৮৩, হাদীস-১৪২৬) রাসূল (সা.)-এর উভয় খুতবা সর্বদাই আরবী ভাষায় হতো।

অতএব, দুই খুতবা আরবী ভাষায় হওয়া সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। জুমু’আর দিন খুতবার আগে স্থানীয় ভাষায় যে দ্বীনি আলোচনা করা হয়, তা খুতবায়ে মাসনুনাহ বলে গণ্য হবে না। কিছু কিছু মানুষ এই দ্বীনি আলোচনাকেও জুমু’আর খুতবা মনে করেন। তাঁদের ধারণা সঠিক নয়। খুতবা আরবী ভাষাতেই হতে হবে, তার প্রমাণসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো :

খুতবা আরবী ভাষায় দেওয়া রাসূলুল্লাহ (সা.), সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবেতাবেঈনসহ আজ পর্যন্ত উম্মতের ধারাবাহিক আমল। অতএব তার বিপরীত আমল করা বিদ’আত ও মাকরূহে তাহরীমি তথা নাজায়েয। উপমহাদেশের বিখ্যাত ফকীহ ও মুহাদ্দিস শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (রহ.) তাঁর রচিত মুয়াত্তায়ে মালেকের ব্যাখ্যাগ্রন্থ মুসাফফায় উল্লেখ করেন:

لما لا حظنا خطبة النبى صلى الله عليه وسلم وخلفائه رضى الله عنهم وهلم جرا فنجد فيها وجوذ اشياء، منها الحمد والشهادتان والصلاة على النبى صلى الله عليه وسلم والامر بالتقوى وتلاوة آية والدعاء للسملمين والمسلمات وكون الخطبة عربية

অর্থ: রাসূলুল্লাহ (সা.), খুলাফায়ে রাশেদীন, তাবেঈন, তাবেতাবেঈন এবং পরবর্তী যুগের ফুকাহায়ে কেরাম ও উলামায়ে দ্বীনের খুতবাসমূহ লক্ষ করলে দেখা যায় যে তাঁদের খুতবায় নিম্নের বিষয়গুলো ছিল। যথা : আল্লাহ তাআলার হামদ , শাহাদাতাইন (অর্থাৎ তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য প্রদান করা) রাসূল (সা.)-এর প্রতি দরূদ, তাকওয়ার আদেশ, পবিত্র কোরআনের আয়াত তেলাওয়াত, মুসলমানদের জন্য দু’আ। তাঁরা সকলেই আরবী ভাষায় খুতবা দিতেন। গোটা মুসলিম বিশ্বের বহু অঞ্চলের ভাষা আরবী নয়, তবুও সর্বত্র আরবী ভাষায়ই খুতবা দেওয়া হতো। (মুসাফফা, ১/১৫৪) এমন মনে করা ঠিক নয় যে, রাসূল (সা.) ও সাহাবীদের যুগে অনারবী ভাষায় খুতবা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। কারণ, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শেষ যামানায় দলে দলে লোক ইসলামে প্রবেশ করতে থাকে। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন:

وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا

অর্থ : ‘আর আপনি দেখবেন লোকেরা দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করছে।’ (সূরা নাছর, আয়াত-

২)

উক্ত আয়াত দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পেছনে বিভিন্ন ভাষার মানুষ নামায আদায় করত। খুতবা ছাড়া দ্বীনি শিক্ষার অন্য কোনো মাধ্যমও তেমন ছিল না। তার পরও রাসূলুল্লাহ (সা.) অন্য ভাষায় খুতবা অনুবাদের ব্যবস্থা করেননি। তদ্রƒপ সাহাবীগণের যুগে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) সম্পর্কে বুখারী শরীফ ১/১৩ তে বর্ণিত আছে, তিনি নিজের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য দোভাষী ব্যবহার করতেন। তবুও তিনি স্থানীয় ভাষায় খুতবা দেওয়া বা খুতবার অনুবাদের ব্যবস্থা করেননি। খুতবাকে দুই রাক’আত নামাযের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। তাই নামাযে যেমন ক্বেরাত আরবী ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় আদায় করা যায় না, খুতবাও আরবী ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় দেওয়া যাবে না। আল্লামা আবু বকর ইবনে শাইবা (রহ.) উল্লেখ করেন:

عن عمر بن الخطاب أنه قال: إنما جعلت الخطبة مكان الركعتين

অর্থ: হযরত উমর (রা.) বলেন, জুমু’আর খুতবাকে দুই রাক’আত নামাযের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বাহ, হাদীস-৫৩২৪)

অন্যত্র হযরত উমর (রা.) থেকে বর্ণিত আছে:

عن عمر بن الخطاب قال: كانت الجمعة اربعا فجعلت ركعتين من أجل الخطبة

অর্থ: হযরত উমর (রা.) বলেন, জুমু’আর নামায চার রাক’আত ছিল। এরপর খুতবার কারণে দুই রাক’আত করা হয়েছে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বাহ, হাদীস-৫৩৩১) ইমাম বায়হাকী (রহ.) আস-সুনানুল কুবরা গ্রন্থে ৫৭০৩ নং হাদীসে উল্লেখ করেন:

كانت الجمعة اربعا فجعلت الخطبة مكان الركعتين

অর্থ : জুমু’আর নামায চার রাক’আত ছিল। খুতবাকে দুই রাক’আতের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে।

পবিত্র কোরআনে খুতবাকে যিকর বলা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ (৯)

অর্থ : হে মুমিনগণ, যখন জুমু’আর দিনে সালাতের জন্য আহ্বান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে ধাবিত হও। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরীনগণ লিখেছেন, এখানে ‘যিকর’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ‘খুতবা’। এ ব্যাপারে নিম্নে কয়েকটি তাফসীরের উদ্ধৃতি পেশ করা হলো :

১। তাফসীরে রুহুল মাআনী, খ- ১৩, পৃষ্ঠা ৭০২-এ উল্লেখ আছে:

والمراد بذكر الله الخطبة الصلاة

অর্থ: আল্লাহর যিকর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, খুতবা ও নামায।

২। ইমাম রাযী (রহ.) আত-তাফসীরুল কাবীর গ্রন্থে লেখেনÑ (খ- ৯, পৃষ্ঠা ৩০)

الذكر هو الخطبة عند الأكثر من اهل التفسير

অর্থ : অধিকাংশ মুফাসসিরগণের নিকট যিকর দ্বারা খুতবা উদ্দেশ্য।

৩। আহকামুল কোরআন খ- ৩, পৃষ্ঠা ৫৯৬-এ বর্ণিত আছে:

ويدل على ان المراد بالذكر ههنا الخطبة، ان الخطبة هى اللتى تلى النداء، وقد امر بالسعى اليه

অর্থ : যিকর থেকে যে খুতবাই উদ্দেশ্য, তার প্রমাণ আল্লাহ তা’আলা বলেন, আযান হলে যিকিরের দিকে আসো। আর আযানের সাথে সাথে খুতবাই প্রদান করা হয়।

৪। তাফসীরে ইবনে কাসীরে খ- ৯, পৃষ্ঠা ৪৫৬-এ উল্লেখ আছে: فان المراد من ذكر الله الخطبة

অর্থ : আল্লাহর যিকর দ্বারা খুতবাই উদ্দেশ্য। হাদীস শরীফেও খুতবাকে ‘যিকর’ বলা হয়েছে। সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত একটি হাদীস নিম্নে উল্লেখ করা হলো :

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: مَنِ اغْتَسَلَ يَوْمَ الجُمُعَةِ غُسْلَ الجَنَابَةِ ثُمَّ رَاحَ، فَكَأَنَّمَا قَرَّبَ بَدَنَةً، وَمَنْ رَاحَ فِي السَّاعَةِ الثَّانِيَةِ، فَكَأَنَّمَا قَرَّبَ بَقَرَةً، وَمَنْ رَاحَ فِي السَّاعَةِ الثَّالِثَةِ، فَكَأَنَّمَا قَرَّبَ كَبْشًا أَقْرَنَ، وَمَنْ رَاحَ فِي السَّاعَةِ الرَّابِعَةِ، فَكَأَنَّمَا قَرَّبَ دَجَاجَةً، وَمَنْ رَاحَ فِي السَّاعَةِ الخَامِسَةِ، فَكَأَنَّمَا قَرَّبَ بَيْضَةً، فَإِذَا خَرَجَ الإِمَامُ حَضَرَتِ المَلاَئِكَةُ يَسْتَمِعُونَ الذِّكْرَ

অর্থ : হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি জুমু’আর দিন জানাবাতের গোসল করে সর্বপ্রথম রওনা হলো, সে যেন একটি উট কোরবানী করল। দ্বিতীয় পর্যায়ে যে ব্যক্তি উপস্থিত হলো, সে যেন একটি গরু কোরবানী করলো। তৃতীয় নম্বরে যে উপস্থিত হলো, সে যেন একটি বকরি কোরবানী করল। চতুর্থ নম্বরে যে ব্যক্তি উপস্থিত হলো, সে যেন একটি মুরগি সদকা করল। পঞ্চম নম্বরে যে উপস্থিত হলো, সে যেন একটি ডিম সদকা করল। এরপর যখন ইমাম (খুতবার) জন্য বের হয়ে আসেন, ফেরেশতারা উপস্থিত হন, তাঁরা মন দিয়ে যিকর (খুতবা) শ্রবণ করেন। (বুখারী শরীফ, ১/১২৭, হাদীস-৮৩২, মুসলিম শরীফ, হাদীস-১৪০৩, তিরমিযী শরীফ, হাদীস-৪৫৯, নাসায়ী শরীফ, হাদীস-১৩৭১, আবু দাউদ শরীফ, হাদীস-২৯৭)

ফুকাহায়ে কেরামও খুতবাকে যিকর বলেন। যেমন শামছুল আইম্মা সারাখছী (রহ.) বলেন: ولنا ان الخطبة ذكر

অর্থ : আমাদের নিকট খুতবা একটি বিশেষ যিকর। (আল-মাবসুত, ২/৪২) যখন এ কথা প্রমাণিত যে, খুতবা একটি বিশেষ যিকর, আর যিকর আরবী ভাষাতেই হতে হয়, তাই খুতবাও আরবীতেই হতে হবে। ‘খুতবা নামাযের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এ কারণেই হাদীস শরীফে খুতবার জন্য এমন কিছু শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে, যা শুধু নামাযের জন্য প্রযোজ্য।

যেমন :

ক) নামাযের জন্য যেমন ওয়াক্ত নির্ধারিত রয়েছে, খুতবার জন্যও ঠিক ওই ওয়াক্তই নির্ধারিত। ওয়াক্ত হওয়ার পূর্বে বা পরে খুতবা দিলে তা সহীহ হয় না।

খ) জুমু’আর নামাযে যেমন ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নাত রয়েছে, জুমু’আর খুতবার জন্যও তদ্রুপ ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নাত রয়েছে।

গ) নামাযের জন্য যেমন পবিত্রতা শর্ত, তদ্রুপ খুতবার জন্যও পবিত্রতা জরুরি। ওজুবিহীন খুতবা দেওয়া মাকরূহ। ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.)-এর মতে নাজায়েয।

ঘ) নামাযের পূর্বে ইকামত দিতে হয়, তদ্রুপ খুতবার পূর্বে আযান দিতে হয়।

ঙ) নামাযের মধ্যে সালাম-কালাম করা যায় না । খুতবাতে ও সালাম-কালাম করা যায় না। নামাযে কারো হাঁচির উত্তর দেওয়া যায় না, সালামের জবাবও দেওয়া যায় না। তেমনিভাবে খুতবাতেও কারো হাঁচি ও সালামের জবাব দেওয়া যায় না।

চ) নামায যেমন দাঁড়িয়ে পড়া হয়, খুতবাও তেমনি দাঁড়িয়ে দেওয়া হয়। হাদীস শরীফে আরো উল্লেখ আছে, ইমাম সাহেব যখন খুতবা দেওয়ার জন্য হুজরা থেকে বের হবেন, তখন কোনো নামায ও কথাবার্তা বলা নিষেধ। (আবু দাউদ শরীফ, ১১১২) অন্যত্র বর্ণিত আছে, জুমু’আর দিন ইমামের খুতবা প্রদানকালে যদি কেউ অন্যকে বলে, চুপ করো, তবে সেটাও অন্যায় হবে। (নাসায়ী শরীফ, হাদীস – ১৪০১, আবু দাউদ, হাদীস-১১১২)

যেহেতু খুবতা নামাযের মতো, অতএব নামাযে যেমন আরবী ছাড়া অন্য কোনো ভাষা ব্যবহার করা জায়েয নেই, তদ্রƒপ খুতবার মধ্যেও আরবী ছাড়া অন্য কোনো ভাষা ব্যবহার করা জায়েয হবে না। খুতবা ইসলামের একটা প্রতীক। অর্থাৎ আযান, ইকামত, নামায, তাকবীর এগুলো যেমন ইসলামের প্রতীক, তেমনি খুতবাও একটি প্রতীক। আযান-ইকামত যেমন অন্য ভাষায় দেওয়া যায় না, তেমনি খুতবাও অন্য ভাষায় দেওয়া যাবে না। ‘আরবী ভাষা মুসলমানদের ধর্মীয় ভাষা। এ ভাষা শিক্ষা করা ফরজে কেফায়া। কারণ কোরআন-হাদীস বোঝা আমাদের কর্তব্য । কোরআন-হাদীস বোঝার জন্য আরবী জ্ঞান থাকা আবশ্যক। এই আরবী শেখার প্রতি উৎসাহিত করার জন্য আরবীতে খুতবা দেওয়া হয়। একজন আরবী না জানা ব্যক্তির সামনে যখন প্রতি সপ্তাহে আরবীতে খুতবা দেওয়া হবে, তখন তার সামনে নিজের অক্ষমতা বারবার স্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে। যা তাকে আরবী শিখতে উৎসাহিত করবে।

আরবী ভাষায় খুতবা জরুরি হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো, পুরো মুসলিম উম্মাহর মাঝে তাওহীদ ও ঐক্যের প্রতীক হলো খুতবা। মুসলমান পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাক, প্রতি জুমু’আয় আরবী ভাষার খুতবা তাদের মাঝে সেতু বন্ধনের কাজ করবে। সব জায়গায় যদি নিজ নিজ মাতৃভাষায় খুতবা হতে থাকে, তাহলে কোনো এলাকায় আগন্তুক ব্যক্তি অন্যান্য বিষয়ের মত ইবাদতেও নিজেকে একজন অপরিচিত ভাবতে থাকবে। ‘খুতবা আরবীতে হওয়ার আরেকটি হিকমত হলো, ভাষার প্রভাব সর্বত্র বিরাজমান। শাইখুল ইসলাম আল্লামা হাফেয ইবনে তাইমিয়া (রহ.) তাঁর কিতাব ‘ইকতেযা-উস-সিরাতিল মুসতাকীম’ ১/৪২৪-এ উল্লেখ করেন:

واعلم ان اعتياد اللغة يؤثر فى العقل والخلق، والدين تأثير قويا بينا

অর্থ: জেনে রাখা উচিত যে, কোনো বিশেষ ভাষায় অভ্যস্ত হওয়া চিন্তাচেতনা, আখলাক-চরিত্র ও দ্বীন-ধর্মের মধ্যে শক্তিশালী ও স্পষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। এ জন্য রাজা-বাদশাহগণ তাঁদের দেশে নিজ নিজ ভাষার প্রচলন করার চেষ্টা করেন। আর সে কারণেই যেসব এলাকা সাহাবীদের হাতে বিজিত হয়েছে, সেগুলো আজ মামালেকে আরাবিয়া তথা আরব দেশ বলে গণ্য হয়ে আসছে। কেননা, সেসব দেশে যখন সব বিষয়ে আরবী ভাষার অনুপ্রবেশ ঘটেছে, তখন সবাইকে বাধ্য হয়েই আরবী ভাষা শিখতে হয়েছে। সাহাবীদের পরে যেসব এলাকা বিজিত হয়েছে, সেগুলো আরব দেশ বলে গণ্য হয়নি। সাহাবীগণ তাঁদের শত বছরের ইতিহাসে কোনো দিন আরবী ছাড়া অন্য ভাষ ায় খ ুত বা দেনি ন। সাহাবীদের যুগে বহু অনারব দেশ বিজয় হয়ে মুসলমানদের কর্তৃত্বে এসেছিল, যেগুলোর অনেক স্থানেই ভিন্ন ভাষা প্রচলিত ছিল। তখন দ্বীনের তাবলীগ ও মাসলা-মাসায়েলের তালীম দেওয়ার উদ্দেশ্যে স্থানীয় ভাষায় জুমু’আর খুতবা প্রদানের প্রয়োজন ছিল বেশি।

কেননা, খুতবা ছাড়া মাসলা-মাসায়েল শিক্ষা-দীক্ষার জন্য কোনো কিতাবাদী রচিত হয়েছিল না। তখন বেশ কিছু সাহাবী ও তাবেয়ী অনারবী বিভিন্ন ভাষায় অত্যন্ত দক্ষও ছিলেন। তবুও তাঁরা আরবী ভাষাতেই খুতবা প্রদান করতেন। এমনকি হযরত সালমান ফারসী (রা.) তাঁর মাতৃভাষা ফারসী হওয়া সত্ত্বেও পারস্যের এক যুদ্ধে সেনাপতি থাকাকালে সেখানকার ফারসী ভাষাভাষী লোকদের সাথে আরবীতে কথা বলেছেন। দোভাষী তার অনুবাদ করেছে। একপর্যায়ে দোভাষীর অনুবাদ যথার্থ না হওয়ার আশংকায় হযরত সালমান ফারসী (রা.) নিজেই কোরআন শরীফের একটি বাক্যের ফারসী অনুবাদ করেন । ( তিরমিযী শরীফ , হাদীস-১৫৪৮)

এ হাদীস দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, সাহাবীগণ শুধুমাত্র জুমু’আর খুতবাই নয়, বরং যে সকল স্থানে বিপক্ষের নিকট মুসলমানদের মর্যাদা প্রকাশের বিষয় জড়িত ছিল, সেখানে আরবী ভাষাই ব্যবহার করতেন। সারকথা, রাসূলুল্লাহ (সা.), সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন ও তাবেতাবেঈনের যামানা হতে আজ পর্যন্ত উম্মতের ধারাবাহিক আমল হলো আরবী ভাষায় খুতবা প্রদান করা। তাঁরা কখনো আরবী ছাড়া অন্য ভাষায় খুতবা দেননি। সুতরাং আরবী ছাড়া অন্য ভাষায় খুতবা দেওয়া বা আরবীতে খুতবা পাঠ করে নামাযের পূর্বে অন্য ভাষায় তার অনুবাদ করা বিদ’আত ও নাজায়েয। যেমন নিন্মোক্ত কিতাবগুলোতে উল্লেখ আছে:

ولا شك فى ان الخطبة بغير العربية خلاف السنة المتوارثة من النبى والصحابة، فيكون مكروها تحريما

অর্থ: অনারবী ভাষায় খুতবা দেওয়া রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরামের ধারাবাহিক সুন্নাত আমলের পরিপন্থী। অতএব, তা মাকরূহে তাহরীমি হবে। (উমদাতুর রিআয়া, ১/২০০, ফাতাওয়া মাহমুদিয়া, ১২/৩৫৮, আহসানুল ফাতাওয়া, ৪/১৫০, জাওয়াহিরুল ফিক্বহ, ১/৩৫২)

হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে: عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيهِ، فَهُوَ رَدٌّ

অর্থ: হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আমাদের ধর্মে নেই এমন বিষয় ধর্মীয় বিষয় বলে আবিষ্কার করে, তা পরিত্যাজ্য। (বুখারী শরীফ, হাদীস-২৪৯৯, মুসলিম শরীফ, হাদীস-৩২৪২, ইবনে মাযাহ শরীফ, হাদীস-১৪, আবু দাউদ শরীফ, হাদীস-৩৯৯০)

হযরত ইরবায বিন সারিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন:

مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا، فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ، تَمَسَّكُوا بِهَا، وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ، وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ، فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ (২) بِدْعَةٌ، وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ “

অর্থ : তোমাদের মাঝে আমার পর যারা জীবিত থাকবে, তারা অনেক মতভেদ দেখবে। তখন তোমাদের ওপর আমার এবং আমা র হেদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত আঁকড়ে ধরা জরুরি। সেটিকে মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে রাখবে। আর সাবধান থাকবে, নব উদ্ভাবিত ধর্মীয় বিষয় থেকে। কেননা, ধর্ম বিষয়ে প্রতিটি নতুন বিষয়ই বিদ’আত। আর প্রতিটি বিদ’আতই গোমরাহী। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস-১৬৫২১)

খুতবার পূর্বে বয়ানের শরয়ী হুকুম

প্রথম আযানের পূর্বে বা পরে এবং ছানী আযানের অবশ্যই পূর্বে ওয়াজ-নসীহত করা বৈধ। হযরত সাহাবায়ে কেরাম (রা.) থেকে তা প্রমাণিত আছে।

عَاصِمُ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ زَيْدٍ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: كَانَ أَبُو هُرَيْرَةَ يَقُومُ يَوْمَ الْجُمُعَةِ إِلَى جَانِبِ الْمِنْبَرِ فَيَطْرَحُ أَعْقَابَ نَعْلَيْهِ فِي ذِرَاعَيْهِ ثُمَّ يَقْبِضُ عَلَى رُمَّانَةِ الْمِنْبَرِ، يَقُولُ: قَالَ أَبُو الْقَاسِمِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ مُحَمَّدٌ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: قَالَ الصَّادِقُ الْمَصْدُوقُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، ثُمَّ يَقُولُ فِي بَعْضِ ذَلِكَ: وَيْلٌ لِلْعَرَبِ مِنْ شَرٍّ قَدِ اقْتَرَبَ فَإِذَا سَمِعَ حَرَكَةَ بَابِ الْمَقْصُورَةِ بِخُرُوجِ الْإِمَامِ جَلَسَ. هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحٌ عَلَى شَرْطِ الشَّيْخَيْنِ

অর্থ : আসেম (রহ.) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, জুমু’আর দিন হযরত আবু হুরায়রা (রা.) জুতা খুলে মিম্বরের পাশে দাঁড়িয়ে মিম্বর ধরে বলতেন, আবুল কাসেম (সা.) বলেন, মুহাম্মাদ (সা.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেন, সাদেক মাসদুক (সা.) বলেন, ধ্বংস আরবদের জন্য, ওই ফিতনার কারণে, যা নিকটবর্তী…। এরপর যখন ইমাম সাহেবের বের হবার আওয়াজ শুনতেন, তখন তিনি বসে যেতেন। (মুসতাদরাকে হাকেম, ১/১৯০, হাদীস-৩৩৮)

عَنْ أَبِي الزَّاهِرِيَّةِ، قَالَ: كُنْتُ جَالِسًا مَعَ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ بُسْرٍ يَوْمَ الْجُمُعَةِ فَمَا زَالَ يُحَدِّثُنَا حَتَّى خَرَجَ الْإِمَامُ

হযরত আবদুল্লাহ বিন বুছর (রা.) জুমু’আর দিন প্রথমে ওয়াজ করতেন। যখন খতীব খুতবার জন্য আগমন করতেন, তখন তিনি ওয়াজ বন্ধ করতেন। (মুসতাদরাকে হাকেম, ১/২৮৮, হাদীস-১০১২)

হযরত তামীম দারী (রা.) হযরত উমর (রা.) ও হযরত উসমান (রা.)-এর যুগে খুতবার পূর্বে ওয়াজ করতেন। (মুসনাদে আহমাদ, ৩১/৩৩১, হাদীস-১৫১৫৭)

কিন্তু সাহাবীগণ কেউ জুমু’আর পূর্বের এ বয়ানকে খুতবা বা খুতবার অংশ গণ্য করতেন না। বরং এরপর দুটি খুতবা দেওয়া হতো। লা-মাযহাবীদের কিছু যুক্তি ও তার জবাব স্থানীয় ভাষায় খুতবা প্রদানের ব্যাপারে লা-মাযহাবীদের নিকট কোরআন-সুন্নাহ হতে কোনোই দলিল নেই। এ ক্ষেত্রে কোরআন ও সহীহ হাদীস ত্যাগ করে তারা কিছু খোড়া যুক্তির আশ্রয় নিয়ে থাকে। আমরা তা উল্লেখ করে জবাব প্রদান করছি।

যুক্তি-১ :

খুতবা আরবী শব্দ। তার অর্থ বক্তৃতা বা ভাষণ। বক্তৃতা বা ভাষণ যেমন যেকোনো ভাষায় দেওয়া যায়, তদ্রƒপ খুতবাও যেকোনো ভাষায় দেওয়া যাবে।

আমাদের জবাব :

যুক্তিটি সঠিক নয়। কারণ, শরীয়তের পরিভাষাগুলো শাব্দিক অর্থে বিবেচিত হয় না। বরং শরীয়তে তাকে যে অর্থের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সেই অর্থেই ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন ‘সালাত’ আরবী শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ নিতম্ব দোলানো, দু’আ করা ইত্যাদি। শাব্দিক অর্থে সালাত আদায় করা গেলে দিনে পাঁচবার নিতম্ব দোলালে বা দু’আ করলেই চলত। কিন্তু এমন কথা কোনো পাগলও বলবে না। বরং শরয়ী অর্থ অনুযায়ী দিনে পাঁচবার নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট নিয়মে সালাত আদায় করতে হয়। তদ্রƒপ জুমু’আর খুতবাও শাব্দিক অর্থে শুধু ভাষণ দিলে হবে না। বরং শরয়ী নিয়মে জুমু’আর পূর্বে আরবী ভাষায় দিতে হবে।

যুক্তি-২ :

ওয়াজ বা ভাষণের নাম খুতবা। আর ওয়াজ-নসিহত বা ভাষণ শ্রোতাদের ভাষায় প্রদান করা উচিত।

আমাদের জবাব :

উক্ত যুক্তিটির দুটি জবাব নিম্নে উল্লেখ করা হলো :

১.

খুতবাকে ওয়াজ বা বক্তৃতা বলা ভুল। কারণ :

ক)

ওয়াজ বা বক্তৃতাকে আরবীতে ‘তাযকীর ’ বলা হয় । অথচ কোরআন-সুন্নায় খুতবাকে ‘যিকর’ বলা হয়েছে। (সূরা জুমআহ, আয়াত – ৯ , বুখারী শরী ফ , হাদীস-৩০১, মুসলিম শরীফ, হাদীস-৮৫০, নাসায়ী শরীফ, হাদীস-১৩৮৬, ইবনে মাযাহ শরীফ, হাদীস-১০৯২)

খ) ফুকাহায়ে কেরাম খুতবাকে দুই রাক’আত নামাযের স্থলাভিষিক্ত বলেছেন। (বাহরুর রায়েক, ২/১০৮) গ) খুতবার জন্য যোহরের ওয়াক্ত হওয়া শর্ত। (বাদায়েউস সানায়ে, ২/২৫৬, আলমগীরি, ১/১৬৮)

যদি খুতবা ওয়াজ বা বক্তৃতার নামই হতো, তাহলে জুমু’আর ওয়াক্ত হওয়ার শর্ত হতো না।

ঘ) খুতবা সহীহ হওয়ার জন্য শুধু পাঠ করা শর্ত। কেউ শোনা জরুরি নয়। এমনকি কয়েকজন বধির কিংবা ঘুমন্ত ব্যক্তির সামনে খুতবা পাঠ করা হলেও জুমু’আ সহীহ হবে। (শামী, ৩/১৯০, বাহরুর রায়েক, ২/১৫৭)

খুতবা যদি ওয়াজ বা বক্তৃতাই হতো, তাহলে বধির বা ঘুমন্ত ব্যক্তির সামনে খুতবা দিলে সহীহ হতো না।

ঙ) জুমু’আ সহীহ হওয়ার জন্য খুতবাকে শর্ত বলা হয়েছে। (দুররে মুখতার, ৩/১৯, ফাতহুল কাদীর, ২/৫৫)

খুতবা যদি ওয়াজ বা বক্তৃতা হতো, তাহলে নামায সহীহ হবার জন্য তাকে শর্ত বলা যুক্তিহীন।

চ) খুতবা দেওয়ার পর খতীব যদি অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ে যান, আর নামায ও খুতবার মাঝে দীর্ঘ সময় ব্যবধান হয়, তাহলে পুনরায় খুতবা দিতে হয়। যদিও শ্রোতা প্রথমবারের ব্যক্তিরাই হোক না কেন। (বাহরুর রায়েক, ২/২৫৮)

যদি খুতবা শুধু ভাষণই হতো, তাহলে একই ভাষণ পূর্বের শ্রোতাদের সামনে আবার বলার কোনোই দরকার ছিল না।

ছ) খুতবা শ্রবণ করা এবং চুপ থাকা ওয়াজিব। যবানে দরূদ শরীফ পড়া, তাসবীহ পাঠ করা, তাকবীর বলা অথবা সালামের উত্তর দেওয়া অবৈধ। খুতবা যদি শুধু ভাষণই হতো, তাহলে সালামের জবাব দেওয়া বা যিকর-আযকার থেকে নিষেধ করা হতো না।

২.

কোরআন শরীফকে অনেক আয়াতে ওয়াজ বা নসীহত বলা হয়েছে। (সূরা ইউনুস, আয়াত-৫৭, সূরা ছাদ, আয়াত-৮৭, সূরা কলম, আয় াত – ৫ ২, সূরা তাকবীর , আয়াত-২৭)

তাহলে খুতবার মতো কোরআনকেও নামাযের মধ্যে স্থানীয় ভাষায় পাঠ করা জায়েয হওয়া উচিত।

কারণ, আরবী তেলাওয়াত শ্রোতারা অনেকেই বোঝে না। কোনো সুস্থ মস্তিস্কসম্পন্ন ব্যক্তি কি তা বৈধ বলবে? তেমনিভাবে আযানের মধ্যে حى على الصلاة না বলে ‘নামাযের দিকে আসো’ বলা উচিত।

ফজরের আযানে الصلاة خير من النوم না বলে ‘নামায ঘুম হতে উত্তম’ বলা উচিত।

কারণ, শ্রোতারা আরবী ভাষায় এ সমস্ত আহ্বান বুঝতে পারে না। অথচ এমন কথা কেউ বলে না।

যুক্তি-৩ :

রাসূলুল্লাহ (সা.) আরবী ভাষায় খুতবা দেননি। বরং মাতৃভাষায় খুতবা দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের মাতৃভাষা আরবী ছিল, এ জন্য তাঁরা আরবী ভাষায় খুতবা দিতেন।

আমাদের জবাব :

এরূপ যুক্তি মূর্খতা ও অজ্ঞতার অন্তর্ভুক্ত। কারণ, উক্ত যুক্তিটি নামায, তেলাওয়াত, আযান ও ইকামতের ব্যাপারেও পেশ করা যেতে পারে। তাহলে কি ওই সব ইবাদতগুলোও রাসূলুল্লাহ (সা.) মাতৃভাষায় আদায় করেছেন বলে যুক্তি দেখিয়ে অন্যরা মাতৃভাষায় আদায় করলে সহীহ হবে? আসলে তাদের এসব যুক্তি ইবাদত নিয়ে খেল-তামাশার অন্তর্ভুক্ত। কোনো ধরনের ইবাদতই আরবী ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় গ্রহণযোগ্য নয়। খুতবাও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত, যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

যুক্তি-৪ :

ইমাম আবু হানীফা (রহ.) নামাযে ফারসী ভাষায় ক্বেরাত পাঠকে বৈধ বলেছেন। অতএব, আরবী ছাড়া অন্য ভাষায় খুতবা দেওয়াও বৈধ হবে।

আমাদের জবাব :

উক্ত যুক্তিটির দুটি জবাব নিম্নে উল্লেখ করা হলো :

১.

ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর উক্ত মতামত থেকে তিনি পরবর্তীতে রুজু (মত প্রত্যাহার) করেছেন। সুতরাং তার এই বর্জিত মতামতটি দলিল হিসেবে পেশ করা বোকার পরিচয় দেওয়া। যেমন হেদায়া কিতাবে ১/১০২ উল্লেখ আছেÑ

ويروى رجوعه فى اصل المسئلة إلى قولهما وعليه الاعتماد، والخطبة والتشهد على هذا الاختلاف

২.

ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর প্রথম মতামত অনুযায়ী খুতবা অনারবী ভাষায় দেওয়া জায়েয দ্বারা উদ্দেশ্য ছিল মাকরূহে তাহরীমির সাথে জায়েয। (শামী, ২/১৮৩, বাহরুর রায়েক , ১/ ৫৩৫ , তাতারখানিয়া, ২/৭৪, সিআয়া, ২/১৫৫)

এ ছাড়া ফিকহে হানাফীর অধিকাংশ কিতাবেই স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, আবু হানীফা (রহ.)-এর মতে অনারবী ভাষায় খুতবা জায়েয দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মাকরূহে তাহরীমির সাথে জায়েয।

৩.

ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর পূর্ববর্তী মতটির উদ্দেশ্য হলো, অনারবী ভাষায় খুতবা দ্বারা যদি আল্লাহর যিকর আদায় হয়ে যায়, তাহলে জুমু’আহ সহীহ হবে। কিন্তু খুতবার সুন্নাত আরবী ভাষা পরিত্যাগ করার কারণে তা মাকরূহ হবে। যেমন খুতবা দাঁড়িয়ে পবিত্র অবস্থায়, শ্রোতাদের দিকে মুখ করে, পূর্ণ লেবাস পরিধান করে পাঠ করা সুন্নাত। কেউ যদি ওযর-কারণ ছাড়া বসে বসে, কিবলামুখী হয়ে, শুধু সতর ঢেকে খুতবা দেয়, তা জায়েয, কিন্তু সুন্নাত পরিপন্থী ও মাকরূহে তাহরীমি হবে।

অতএব, অনারবী ভাষায় খুতবা প্রদান করার ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর পূর্বের মতটিকে দলিল হিসেবে পেশ করা কখনো সঠিক ও যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না। শ্রোতাদের ভাষায় খুতবার প্রবক্তা বন্ধুগণ নিম্নে সমস্যাটির নকলী বা আকলী সমাধান পেশ করবেন কি?

সমস্যা : একটি মসজিদে জুমু’আর দিন খুতবার সময় দশ জন ইংরেজি ভাষী, দশ জন উর্দূ ভাষী, দশ জন ফারসী ভাষী, দশ জন আরবী ভাষী ও দশ জন বাংলা ভাষী মুসল্লি উপস্থিত রয়েছেন। এমতাবস্থায় খতীব সাহেব শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে কোন ভাষায় খুতবা পেশ করবেন? আল্লাহ তাআলা সবাইকে সহীহ বুঝ দান করুন এবং তদানুযায়ী আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

মুফতী মুহাম্মদ শফী কাসেমী

কৃতজ্ঞতা: আহলে হক মিডিয়া।

@কপিরাইট: http://ahlehaqmedia.com/%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a5%e0%a6%…/

 

সংবাদটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন সবার মাঝে

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on print
Print
Share on email
Email
Share on whatsapp
WhatsApp

কোন মন্তব্য নেই। আপনি প্রথম মন্তব্যটি করুন। on স্থানীয় ভাষায় খুৎবা প্রদান: একটি দালীলিক পর্যালোচনা

আপনি কি ভাবছেন ? আপনার মতামত লিখুুন।

এই বিভগের আরো সংবাদ

সর্বশেষ