প্রথম পর্ব
ড. মো. মিল্লাতে মোস্তফা
তিন মাসের একটা কন্সাল্টেন্সি কন্ট্রাক্টে সাইন করি এপ্রিল মাসে। আমাকে ডি আর কংগোতে যেতে হবে USAID এর Monitoring and Evaluation প্রজেক্টে সিনিয়র কন্সাল্টেন্ট হিসাবে। যথারীতি ভিসার জন্য কংগোর লন্ডন এম্বেসিতে আবেদন করি মে মাসের দুই তারিখ। ভেবেছিলাম এক সপ্তাহের মধ্যে ভিসা হয়ে যাবে। মে মাসের চার তারিখ আমি ইংল্যান্ড থেকেই কাজে যোগদান করি।
দুই সপ্তাহ পেরিয়ে যাবার পরও দেখি ভিসার কোন খবর নাই। এম্বেসিতে ফোন করে জানতে পারি আরো দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। এ দিকে রোজা শুরু হয়ে গেছে। বাসায় বসে কাজ করছি। প্রতিদিন সকাল বেলা চিফ অব পার্টির সাথে স্কাইপ মিটিং। তারপর কাজ। দেখতে দেখতে এক মাস পেরিয়ে গেল। কিন্তু ভিসার খবর নাই। এম্বেসিতে প্রতিদিন ফোন দেই। তারা আমাকে আশ্বাস দেয়। আমি কংগো অফিসকে যথারীতি প্রতিদিন ভিসার আপডেট দেই। এভাবে যখন আঠারো রমজান পার হয়ে গেল, তখন আমি আল্লার কাছে দোয়া করতে থাকি ভিসা যেন কমপক্ষে আরো দুই সপ্তাহ পরে আসে। তা হলে আমি ইংল্যান্ডে ঈদ করে যেতে পারবো। কিন্তু কিসমত খারাপ। বিশ রমজানের দিন বেরসিক এম্বেসি যথারীতি আমার ভিসা পাঠিয়ে দিল এবং কংগোতে আমার অফিস কেও আপডেট দিয়ে দিল যেহেতু তারা ব্যাপারটা কংগো থেকে তদবির করছিল।
যাহোক আমেরিকার অফিস থেকে ঐ দিন ই টিকেট পাঠিয়ে দিল। যাত্রার তারিখ ১০ জুন। ঈদের মাত্র পাঁচ দিন আগে। আমার গিন্নীও আমার সাথে আসবেন। ছেলেটা একা একা ঈদ করবে। গত দুই বছর ও সে একা ঈদ করেছে। তাই শেষ পর্যন্ত গিন্নীর টিকেট টা ২১ তারিখ পর্যন্ত পিছিয়ে দিলাম।
দশ তারিখ ভোর বেলা আমার ফ্লাইট সাড়ে ছটায় এয়ার ফ্রান্সে। একমাত্র এই এয়ার লাইন্সে সর্বোচ্চ কম সময় চৌদ্দ ঘন্টা লাগে। বাকিগুলো বিশ থেকে চব্বিশ ঘন্টা। তবে এই ফ্লাইটে আমার অতীত অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। আমি একবার নিজার এবং দুইবার হাইতিতে গিয়েছিলাম এয়ার ফ্রান্সে। তিন বার ই আমার লাগেজ দুই দিন পরে পৌঁচেছে। তার কারন প্যারিসে ট্রানজিট মাত্র দেড় ঘন্টা। এই ফ্লাইটে ট্রানজিট ছিল দুই ঘন্টা। তাদের ব্যবহার ও খুব অমায়িক না। তাছাড়া এয়ারপোর্টে কাষ্টমার সার্ভিসের একটা গা ছাড়া ভাব ও আছে। এরা ইংরেজি বলে না বা বলতে চায় না। অনেকটা এমন ফ্রেঞ্চ বুঝলে বুঝুন, না বুঝলে নাই।
যাহোক বার্মিংহাম এয়ারপোর্টে সঠিক সময়ে বোর্ডিং করলাম। আমার বাসা এয়ারপোর্ট থেকে মাত্র সাত মাইল। ট্রাফিক না থাকলে দশ বারো মিনিটেই পোঁছা যায়। আমার ছেলে এবং গিন্নী আমাকে সি অফ করে গেল। মনটা খুবই খারাপ। গত ৫৪ বছরের জীবনে এই প্রথম একা একা ঈদ করবো।
ফ্লাইট ছাড়ার কথা সাড়ে ছয়টায়। কিন্তু ঘড়ির কাটা সাতে সাতটায় ছুঁই ছুঁই করছে। ফ্লাইট ঠায় রান ওয়েতে দাঁড়ানো। এয়ার হোস্টেস কে জিজ্ঞেস করলাম। বললো প্যারিস থেকে ক্লিয়ারেন্স দিচ্ছে না। সেখানে এয়ারপোর্টে বিমানযট লেগেছে। সেগুলো ছড়িয়ে তারপর ক্লিয়ারেন্স দিবে। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে তাকে বললাম – আমার ট্রানজিট দুই ঘন্টার। সে আশ্বাস দিয়ে বললো – এই ফ্লাইটের প্রায় ৯০ শতাংশ যাত্রীর একই অবস্থা। তারা আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। যাহোক পোনে আটটায় অনুমতি মিললো। বার্মিংহাম থেকে প্যারিস মাত্র একঘন্টা দশ মিনিটের ফ্লাইট। ফ্লাইট যখন প্যারিস ল্যান্ড করলো, তখন স্থানীয় সময় সকাল দশটা। আমার পরবর্তী ফ্লাইট দশটা চল্লিশে। ফ্লাইট চার্টে চেক করে দেখলাম আমার বোর্ডিং গেইট L 49 যেখানে পৌছতে আমার প্রায় বিশ মিনিট লাগবে। অনেক যাত্রী কে দেখলাম দৌড়াচ্ছে বিভিন্ন গেইটের দিকে। যাহোক আমি যখন বোর্ডিং গেইটে পৌঁছলাম, তখন ফ্লাইট ছাড়ার মাত্র পনের মিনিটের মত বাকি ছিল। তারা কথা রেখেছে। ফ্লাইট ছাড়তে আরো আধা ঘন্টা দেরি করেছে।
আমার সহযাত্রী ছিলেন একজন ইরিথ্রিয়ান ভদ্রলোক। তিনি প্যারিস থাকেন। চাকুরী করেন ইউনেস্কোতে এডুকেশন স্পেশালিস্ট হিসাবে। নাম ড. খাদিম সিলিয়া। তিনিও অফিসের কাজে কংগো যাচ্ছেন। ভদ্র লোকের সাথে কথা বলে প্রায় দুই ঘন্টা কাটালাম। এর পর ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। প্রায় তিন ঘন্টা ঘুম দিলাম। ঘুম ভেংগে দেখি ভদ্রলোক সুর করে আস্তে আস্তে মোবাইল থেকে পবিত্র কোরান তেলায়াত করছেন। এত সুন্দর করে কোরান তেলায়াত আমি খুব কমই শুনেছি। বাকি প্রায় তিন ঘন্টা পুরা সময় ই ভদ্রলোক কোরান তেলায়াতে মগ্ন ছিলেন। ভদ্রলোক পরে বললেন তিনি কোরানে হাফেজ।
আমরা মনে করি ইসলামি শিক্ষা মানুষকে পিছনে নিয়ে যায়। বাংলাদেশে থাকতে আমার ও এ ধরনের ধারনা ছিল। যারা ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত, তারা হয়ত সর্বোচ্চ মসজিদের ইমাম হবেন। আর অবসর সময়ে ঘড়ির মেকানিক্স। অথচ বার্মিংহামে যে হাফেজের পিছনে তারাবি পড়েছি, সে এখানে মাদ্রাসা লাইন থেকে এ ল্যাভেল করে এখন ম্যাকানিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।
যাহোক প্রায় নয় ঘন্টা পর আমাদের ফ্লাইট কিনসাসায় নিরাপদে অবতরণ করলো। বিমান বন্দর টা খুব বড় নয়। ঢুকতেই ভেক্সিন সার্টিফিকেট চেক করলো। তারপর ইমিগ্রেশন করে লাগেজের জন্য বেল্টের পাশে দাড়ালাম। এখানে ঢাকা এয়ারপোর্ট এর মতই কিছুটা বিশৃংখলা লক্ষ করলাম। বিশেষ করে গাড়ির ড্রাইভার রা নেম কার্ড নিয়ে লাগেজ বেল্টের পাশে ভিড় করছিল।
প্রায় দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করার পর ও আমার লাগেজ আসেনি দেখে হতাশ হয়ে পড়লাম। এবার ও আমার লাগেজ আসেনি। লাগেজে আমার গিন্নী ঈদের দিনের সহ প্রায় এক সপ্তাহের রান্না করে দিয়েছিল। এয়ারফ্রান্স কাউন্টার থেকে আমাকে বললো লাগেজ আসবে দুইদিন পর। এখন তো আমার ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। খাবার সব তো নষ্ট হবেই। এখন যদি পঁচা গন্ধ ছুটে তা হলে এরা হয়ত আমার লাগেজ ই ফেলে দিবে। অথবা আমাকে জরিমানা ও করতে পারে। আমার গিন্নি অবশ্য খাওয়া সব একটা হার্ড কভার লাগেজ এ দিয়েছে।
মন খারাপ করে এয়ারপোর্ট থেকে বাইরে এসে দেখি ড্রাইভার আমার নাম লেখা কাগজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে লাগেজের কথা বলার পর সে আমাকে গাড়িতে বসিয়ে আবার এয়ারপোর্টে এসে কাউন্টার থেকে আমার লাগেজ সংক্রান্ত কাগজের এক কপি নিয়ে আসলো। সে এ ব্যাপারে অভ্যস্থ। সে বললো এরা কাগজ পত্র হারিয়ে ফেলতে পারে। সে ক্ষেত্রে তারা সেসব লাগেজ পরের ফ্লাইটেই প্যারিস পাঠিয়ে দেয়। তার মানে এ লাগেজ আর জীবনেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এবার মনে লাগেজের জন্য আরেক চিন্তা ঢুকলো। এই ট্রিপে এখন পর্যন্ত প্রত্যেকটা কাজেই বাধা পাচ্ছি। আল্লাহ জানেন শেষ পর্যন্ত আরো কি কি বাধা পেরুতে হয়।
প্রায় পঞ্চাশ মিনিট পর হোটেল এপার্টমেন্টে পোঁছলাম। সাথে আমার কেবিন লাগেজে মাত্র দুই সেট কাপড়। আমার থাকার হোটেলের নাম ELAIS. এপার্টমেন্টে ঢুকে মন ভালো হয়ে গেল। একটা বেশ বড় সিটিং রুম, সাথে ওপেন কিচেন, একটা বাথ রুম ও একটা মাঝারি সাইজের বেড রুম। একটা কিং সাইজের বেড, তার উপর স্থায়ী ভাবে মশারি টানানো। মশারি দুই দিকে খোলা। ভিতরে ঢুকে লেইস দিয়ে গিট মারতে হয়। তারপর ও পুরাপুরি বন্ধ হয় না। মশা চাইলে সহজেই আসা যাওয়া করতে পারে। ভাবলাম এ দেশের মশা হয় অলস, না হয় বোকা। বাংলাদেশের মশা হলে খুশিতে আত্নহত্যা করতো।
যাহোক, এখন ডিনার ও সেহেরির ব্যবস্থা করতে হবে। নিরাপত্তার জন্য হোটেল কম্পাউন্ডের বাইরে যাওয়া যাবে না। হোটেলের রেষ্টুরেন্টে গেলাম। ম্যানু চেক করে দেখলাম একমাত্র ভ্যাজিটেবল র্যাপ ছাড়া বাকি সবই হারাম। দুইটা র্যাপ সাথে ভাত ও সালাদ অর্ডার দিলাম। রুমে নিয়ে খাবো। বিল দেখে মোটামোটি একটা কারেন্ট শক খেলাম। ২৭ ডলার। এ দেশে কংগোলিজ কারেন্সির সাথে ইউ এস ডলার ও চলে। এক ডলার সমান প্রায় পনেরশ কাংগলিজ ফ্রাংক। আমি যে খাবার অর্ডার দিয়েছি, তা ইংল্যান্ডে সর্বোচ্চ পাঁচ – ছয় ডলারে পাওয়া যেত।
যাহোক রুমে এসে ছেলে ও গিন্নীর সাথে কুশলাদি বিনিময়ের পর খেয়ে নামাজ পড়ে ঘুমাতে যাই। চারটায় সেহেরির জন্য উঠতে হবে। এখানে সময় ইংল্যান্ডের সমান। তবে দিন ছোট। ইংল্যান্ডে প্রায় সাড়ে আঠারো ঘন্টা রোজা রেখে এসেছি। এখানে মাত্র তের ঘন্টা। সেহেরির শেষ সময় ৪.৪৭। আর ইফতার ৫.৫৬।
সকাল সাড়ে আটটায় অফিসের গাড়ি আসলো। প্রায় পনের মিনিটের মত লাগলো অফিসে পৌঁছতে। পরিচয় পর্ব শেষ হবার পর সিকিউরিটি কো-অর্ডিনেটর আসলো সিকিউরিটি ব্রিফিং দেয়ার জন্য। ভদ্রলোক আর্মির রিটায়ার্ড মেজর। অনেকদিন ইউ এন বেজে বাংলাদেশ আর্মির সাথে কাজ করেছেন। সিকিউরিটি ব্রিফিং শুনে আমার অবস্থা খারাপ। আমি আগে থেকেই জানতাম কিনসাসাতে নিরাপত্তার সমস্যা আছে। কিন্তু এত খারাপ জানতাম না। তিনি বললেন অফিসের গাড়ি ছাড়া এবং ওনার অনুমতি ছাড়া হোটেল কম্পাউন্ড থেকে বাহির হওয়া যাবে না। সাড়ে পাঁচটার পর হোটেলের দুই দিকের গেট সিল করে দেয়া হয়। এই হোটেলের সব বাসিন্দাই ইউ এন এর বিভিন্ন প্রজেক্টে চাকুরী করেন এবং এদের প্রায় নব্বই শতাংশ আমেরিকান। হোটেল কম্পাউন্ড প্রায় বিশ একরের মত। ভিতরে সুংমিং পুল ও টেনিস কোর্ট সহ বিনোদনের সব ব্যবস্থা আছে।
যাহোক সিকিউরিটি ব্রিফিং এর এক পর্যায়ে আমাকে বললো যদি কখনো ছিনতাই অথবা কোন ধরনের স্ট্রিট রোভারির কবলে পড়ি, তা হলে সাথে সাথে তারা যা চায়, তা যেন দিয়ে দেই। কারন এদের ধৈর্য অনেক কম। না দিলে সাথে সাথে গুলি। এ সব ক্রাইমের সাথে সব টিন এজার রা জড়িত। এরা বাংলাদেশের ছিনতাইকারী দের মত এত ইনোভেটিভ না। না হয় তারা মলম পার্টি, ডাব পার্টির মত নিরাপদ পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারতো।
আমার অফিসের খুব কাছেই একটা মসজিদ পেলাম। জোহরের নামাজ পড়তে যাব শুনে সিকিউরিটি কো অর্ডিনেটর বললো – অপেক্ষা কর, আমি গান ম্যান কল করি। তাকে নিয়ে যেতে হবে। আমি বললাম – থাক, গান ম্যান কল করতে হবে না। আমি অফিসেই নামাজ পড়বো। গান ম্যান কে বিশ্বাস কি। আমি এ দেশে আসার আগে আমার প্রফেশনাল গুরু ফরিদ ভাইয়ের পুত্রবধু থেকে কিছু টিপস নিয়ে এসেছিলাম। তিনি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে স্কোয়াড্রন লিডার। গত বছর ইউ এন মিশনে তিনি কংগোতে ছিলেন। এদেশের পুলিশ রা সবচেয়ে অনিরাপদ। আমার আগের আমেরিকান বস কংগোতে এক বছর ছিল। একবার রাতে সে ক্লাব থেকে হোটেলে ফিরছিল। পথে পুলিশ তার গাড়ি থামিয়ে চেক করার দোহাই দিয়ে তার সব ছিনতাই করে নিয়ে যায়। এ দেশে আসার আগে সে আমাকে শুধু একটাই উপদেশ দিয়েছে। বিপদে পড়লে কখনো যেন পুলিশের শরণাপন্ন না হই।
যাহোক, অফিস থেকে হোটেলে ফিরার পথে ড্রাইভার কে বললাম আমার কিছু কিনা কাটা করা দরকার। পথে কোন সুপারষ্টোরে যেন থামায়। সে হোটেলের কাছে S & K নামক একটি সুপারষ্টোরে আমাকে নিয়ে গেল। ভিতরে ঢুকেই পেলাম ছাগলনাইয়ার এক ভদ্রলোককে। সে এই সুপার স্টোরের এসিস্টেন্ট ম্যানেজার। নাম জানে আলম। বয়স পঁচিশের মত হবে। দেশের একজন লোক পেয়ে কি যে ভালো লাগলো, বুঝাতে পারবো না।
যখন বিল দিতে গেলাম তখন আরেকটা বড় ধাক্কা খেলাম। চাউল এক কেজি ছয় ডলার, টমেটো ৫ ডলার, তেল এক লিটার সাত ডলার, আংগুর ২৯ ডলার, কদু ৬ ডলার। পরে ইন্টারনেটে দেখলাম কিংসাসা পৃথিবীর ষষ্ঠ এক্সপেন্সিভ শহর।
পথে এক লেবানিজ রেস্টুরেন্ট থেকে রাতের খাবার কিনে হোটেলে ফিরলাম।
পরদিন ড্রাইভার কে এয়ারপোর্ট পাঠানো হলো আমার লাগেজ আনার জন্য। আলহামদুলিল্লাহ। আমার সব লাগেজ ঠিক ভাবে এসেছে। তাড়াতাড়ি খাবার লাগেজ খুললাম। বিরানি সব নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু ল্যাম্ব চপ ও চিকেনের কারিগুলো নষ্ট হয়নি। যাহোক ভাত চারটা রান্না করল চলবে। এক সপ্তাহের মত চলবে।
এর ভিতর আরো দুই দিন চলে গেল। আজ শুক্রবার। ঈদের দিন। গত রাতে জানে আলম ফোন করে আমাকে জানিয়ে দিল এখানকার ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল স্টেডিয়ামে সকাল নয়টায় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হবে। সকালে অফিসের গাড়িতে করে নামাজ পড়তে গেলাম। একটু দেরি হওয়াতে স্টেডিয়ামে ঢুকতে পারিনি। বাইরে ঘাসের উপর মহিলাদের পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করলাম। তারপর অফিসে ফিরে গেলাম।
অফিসে যেয়ে দেখি আমার সহকর্মিগন একটা ছোট খাটো পার্টির আয়োজন করেছে। একজন আমাকে এক গ্লাস পানিয় এগিয়ে দিল। বললাম – এটা কি? বললো – এটা লাগার (বিয়ার)। আরেকজন মুখ কাচুমাচু করে বললো – তোমার জন্য রেড ওয়াইনের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি। ড্রাইভারকে পাঠিয়েছি। তুমি আপাতত লাগার দিয়ে শুরু কর। সবাই তাদের ড্রিংক নিয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। এর মধ্যেই দেখলাম এক এক করে সব কলিগ রা তাদের গ্লাসে লাগার নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে টোষ্ট করার জন্য। এ রকম বিপদে জীবনে ও পড়িনি। মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়ছি আর বলছি আল্লাহ এ বিপদ থেকে উদ্ধার কর। সবাই একত্র হবার পর তাদের কে ধন্যবাদ দিয়ে একটি ইমোশানাল বক্তব্য দিলাম। আমি আমার আত্নীয় স্বজনকে কিভাবে মিস করছি, তাদের আন্তরিকতা কিভাবে আমাকে আত্নীয় স্বজনদের অভাব ভুলিয়ে দিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। দেখলাম আমার চোখ দিয়ে দুই এক ফোটা পানি ও আসলো। দেখলাম তাদের ও দুই তিনজনের চোখে পানি। নিজের অভিনয়ে নিজেই মুগ্ধ।
এবার খুব বিনয়ের সাথে বললাম – দেখ আমরা যারা রোজা রেখেছি, তারা আগামি এক মাস পানি ও চা- কফি ছাড়া কোন পানিয় খেতে পারবো না। এ কথা শুনে সবাই খুব আফসোস করলো। একমাস পর আবার সেলিব্রেট করবে বলে আমাকে আশ্বাস দিল। এরমধ্যে সিকিউরিটি কো-অর্ডিনেটর বলে উঠলো – দেখ তোমাদের ঈদে আমি তোমাদের কিছু আর্মি অফিসার কে মিশনে রেড ওয়াইন দিয়ে সেলিব্রেট করতে দেখেছি। এখন আবার বিপদে পড়লাম কিভাবে এটা কাভার দিব। আমি বললাম – তারা নিশ্চয় রোজা রাখেনি। সে বললো – হ্যা। তাদেরকে রোজা রাখতে দেখিনি। আমি বললাম – এ হুকুম শুধু রোজাদার দের জন্য। দেখলাম কাজ হয়েছে। আপাতত বিপদ কেটে গেছে। ভাবছি আস্তে আস্তে তাদেরকে পরে বুঝিয়ে বলবো।
প্রথম পর্ব সমাপ্ত। ভবিষ্যতে সময় পেলে আবার লিখবো ইনশাল্লাহ। সবাই ভালো থাকবেন। ঈদ মোবারক। ১৫ জুন ২০১৮, কিংসাসা, ডি আর কংগো।
millatemustafa@yahoo.com.
কোন মন্তব্য নেই। আপনি প্রথম মন্তব্যটি করুন। on কংগোর ডায়েরি: (প্রথম পর্ব)