২৮ মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৭ রমজান, ১৪৪৫ হিজরি।
২৮ মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৭ রমজান, ১৪৪৫ হিজরি।

প্রস্তাবিত বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইন ২০১৬: নাগরিকত্ব এখন আর রক্ষণশীল নয়

জন্মসূত্রে-বংশসূত্রে প্রবাসীদের নাগরিকত্বের অধিকার রক্ষিত হোক
মোহাম্মদ মারুফ

একবিংশ শতকে নাগরিকত্ব এখন রক্ষণশীল নয়। বিশ্বায়ন শুধু অবাধ বাণিজ্য, পণ্য সরবরাহ ইত্যাদি বিষয়কেই উন্মুক্ত করছে না, মানুষের যাতায়াত, অবস্থান, মেধা, যোগ্যতার মূল্যায়ন এবং নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহারের ক্ষেত্রে এখন নানা উপায় বের করছে।

marufবাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন-২০১৬ এর খসড়া গত ১লা ফেব্রুয়ারী মন্ত্রীপরিষদের নিয়মিত বৈঠকে অনুমোদিত হয়েছে। প্রস্তাবিত এ আইনটি বাংলাদেশের নাগিরকত্ব বিষয়ক যাবতীয় বিষয় নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রথমবারের মত প্রণীত পূর্ণাঙ্গ আইন। ইতোপূর্বে নাগিরকত্ব বিষয়ক বিধি-বিধান পাকিস্তান আমলে প্রণীত ‘দি সিটিজেনশীপ অ্যাক্ট ১৯৫১ এবং ‘দি বাংলাদেশ সিটিজেনশীপ টেম্পোরারি প্রভিশন্স অর্ডার-১৯৭২’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত।

বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন ২০১৬ এর খসড়া অনুমোদনের পর সংবাদপত্রে সাক্ষাতকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যৈষ্ঠ সচিব মোজাম্মেল হক বলেন- বাংলাদেশ নাগরিকত্ব অধ্যাদেশ, ১৯৭২ এবং আইন কমিশনের ২০০৫ ও ২০১২ সালে সুপারিশের আলোকে নাগরিকত্বের খসড়া আইনটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন- এ আইনে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ বা বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস বা জাহাজ কিংবা বিমানে জন্মগ্রহণ, বাংলাদেশি নাগরিকদের সন্তান ও তাঁদের সন্তান, দ্বৈত নাগরিক, অর্জিত নাগরিকত্ব, বৈবাহিক সূত্র, নতুন সংযুক্ত ভূখন্ডের অধিবাসী এবং বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ চেয়ে আবেদন করা ব্যক্তিরা নাগরিকত্বের জন্য যোগ্য বিবেচিত হবেন। এ ছাড়া বিশেষ অবদানের জন্য সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে খসড়া আইনে।

বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন-২০১৬ বিলটি জনসাধারণের জন্য এখনো উন্মুক্ত করা হয়নি। আমাদের কাছে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়নকল্পে আনীত বিল ২০১৫ এর অনুলিপি রয়েছে। মূলত এই বিলের উপর ভিত্তি করেই দেশে-বিদেশে প্রস্তাবিত আইন নিয়ে আলোকপাত, মতামত প্রদান করা হচ্ছে।

প্রস্তাবিত এই বিলে ৬টি অধ্যায়ে ২৮টি ধারা রয়েছে। এই ধারাসমূহ নাগরিকত্ব অর্জন, বংশসূত্রে নাগরিকত্ব, প্রবাসীগণের নাগরিকত্ব, প্রবাসী নাগরিকগণের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা, দ্বেত নাগিরকত্ব, সম্মানসূচক নাগরিকত্ব, দেশীয়করণসূত্রে নাগরিকত্ব, বৈবাহিকসূত্রে নাগিরকত্ব, ভূখন্ড সংযোজনসূত্রে নাগরিকত্ব, নাগরিকত্বের অযোগ্যতা, পরিত্যাগ, অবসান, অপরাধ, বিচার, দন্ড বিষয়ক বিধান-নীতিমালার সন্নিবেশ ঘটেছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৫ বছর। বিলম্বে হলেও বর্তমান সরকার একটি পূর্ণাঙ্গ নাগরিকত্ব আইন প্রবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছেন। এজন্য তারা সাধুবাদ পেতে পারেন। তবে খসড়া বিলটি আদ্যোপান্ত পড়ে এটিকে সুলিখিত বলা যেমন যাবে না তেমনি ভুল, সংবিধানের মৌলিক বিষয়ের সাথে সাংঘর্ষিকতা ইত্যাদির কারণে এই বিলের গ্রহণযোগ্যতা তথা সংকীর্ণ চিন্তা-উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবনা-মতামত প্রতিফলনের সম্ভাব্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পারে যে কেউ।

পূর্ণাঙ্গ বিল নিয়ে মতামত ব্যক্ত করা বর্তমান লেখার উদ্দেশ্য নয়। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ যারা রয়েছেন আমার বিশ্বাস তারা এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোকপাত করবেন। আমরা প্রবাসীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কিছু ধারা-উপধারা নিয়ে এখানে আলোচনা করতে চাই।

২.
প্রস্তাবিত বিলের ৫নং ধারা ১ উপধারায় বংশসূত্রে নাগরিকত্বের বেলায় বলা হয়েছে- কোন ব্যক্তি বাংলাদেশের বাইরে জন্মগ্রহণ করলেও বাংলাদেশের নাগরিক হবেন যদি তার পিতা বা মাতা এই আইন কার্যকর হইবার অব্যবহিত পূর্বে বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে থাকেন।

৫নং ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে- উপধারা (১) এর বিধান সত্বেও কোন ব্যক্তি বংশসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হবেন না, যদি তার জন্মের ২ বছর বা এই অইন বলবৎ হবার ২ বছরের মধ্যে, যা পরে ঘটে, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশী মিশনে তার জন্ম নিবন্ধন না করেন।

৬ নং ধারায় প্রবাসীগণের নাগরিকত্ব বিষয়ে রয়েছে- বিদেশে বসবাসকারী কোন ব্যক্তি বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতি ও শর্তে সরকারের নিকট তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভ করতে পারবেন যদি তার পিতা বা মাতা বা পিতামহ বা মাতামহ তিনি বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণের পূর্বে বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে থাকেন।

৭ নং ধারা প্রবাসী নাগরিকগণের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা বিষয়ে বলা হয়েছে- (১) এই আইন কিংবা অন্য কোন আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন ধারা ৬ এর অধীন নাগরিকত্ব প্রদান এবং বহাল রাখবার ক্ষেত্রে সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, যে কোন শর্ত আরোপ করতে পারবে।

ধারা ৭ এর উপধারা (২)এ আছে- ধারা ৬ এর অধীন নাগরিকত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিগণ নি¤œবর্ণিত অধিকারসমূহ ভোগ করতে পারবেন না, যথা
ক) জাতীয় সংসদের সদস্য পদে নির্বাচন, খ) রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন, গ) সুপ্রীম কোর্টের বিচারকসহ প্রজাতন্ত্রর কোন কর্মে নিয়োগলাভ, ঘ) স্থানীয় সরকারসহ যে কোন পদে নির্বাচন এবং ঙ) কোন রাজনৈতিক সংগঠন করা।

৮নং ধারায় দ্বৈত নাগরিকত্ব বিষয়ে আওতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সার্কভুক্ত দেশ, মায়ানমার বা সরকার কর্তৃক গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা নাগরিকত্ব গ্রহণের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত রাষ্ট্র ব্যতীত বাংলাদেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে এমন যে কোন রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করা যাবে।

এছাড়াও নাগরিকত্ব আইনে অপরাধ জামিন অযোগ্য, একলক্ষ টাকা জরিমানাসহ সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের সাজার বিধান রয়েছে।

২.১
বিলের দ্বিতীয় অধ্যায়, ধারা ৪, উপধারা ১-এ রয়েছে- বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হইবেন যদি তাহার পিতা বা মাতা এই আইন বলবৎ হইবার তারিখে বা উহার পরে অথবা ১৯৭১ সনের ২৬ মার্চ হইতে এই আইন বলবৎ হইবার অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হন বা থাকেন।
ধারা ২ এর উপধারা ১ এর খ-তে উল্লেখ রয়েছে- উপধারা ১ এ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোন ব্যক্তি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হইবেন না, যদি তাহার পিতা বা মাতা বিদেশি শত্রু হন।

এই ধারায় উল্লেখিত বিধানটিও সংবিধানসম্মত নয়। পিতা-মাতার অপরাধের জন্য সন্তানের শাস্তি-নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত। তা আইন চূড়ান্ত করার আগে গভীরভাবে বিবেচনার দাবী রাখে। এছাড়াও ১৯৭১ সনের ২৬ মার্চের পূর্বে জন্মগ্রহণকারীদের জন্মসুত্রে নাগরিকত্বের ব্যাপারে কিছু উল্লেখ নেই।

৩.
একবিংশ শতকে নাগরিকত্ব এখন রক্ষণশীল নয়। বিশ্বায়ন শুধু অবাধ বাণিজ্য, পণ্য সরবরাহ ইত্যাদি বিষয়কেই উন্মুক্ত করছে না, মানুষের যাতায়াত, অবস্থান, মেধা, যোগ্যতার মূল্যায়ন এবং নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহারের ক্ষেত্রে এখন নানা উপায় বের করছে। এমনকি যে সমস্ত দেশে নাগরিকত্ব বিষয়ে রক্ষণশীলতা রয়েছে তারাও বর্তমানে নাগরিকত্ব বিশেষ করে নিজ দেশের প্রবাসী নাগরিকদের নিজ দেশমুখী করতে নানা উপায় খুঁজে বের করছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের নতুন প্রস্তাবিত আইনটি যদি আমরা বিবেচনা করি। তাহলে আমাদেরকে রীতিমত বিস্মিত ও হতবাক হতে হবে।

আমরা প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স নিয়ে গর্ব করি। প্রবাসীদের দেশমুখী করতে নানা উদ্যোগের কথা বলি, দেশে বিনিয়োগের কথা বলি। আবার অপরদিকে আইন করে দেশের নাগরিককে বঞ্চিত করি। দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে তাদের বিবেচনা করি। শুধু তাই নয় প্রস্তাবিত আইন দ্বারা প্রবাসের তৃতীয়, চতুর্থ প্রজন্মকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার পুরো বন্দোবস্ত করা হয়েছে।

দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্ম যেহেতু এই আইন করার পূর্বে নাগরিক ছিলেন না সেহেতু ৭নং ধারা মতে তাদের সন্তান নাগরিক হিসেবে আবেদনই করতে পারবেন না। এমতাবস্থায় প্রবাসী এ প্রজন্মের বিষয়ে আইনে কিছুই উল্লেখ নেই। অপরদিকে ৬নং ধারা অনুযায়ী নাম তালিকাভুক্তির মাধ্যমে দ্বিতীয় প্রজন্ম যদি নাগরিক হয় তাহলে তাদের সন্তানাদির বেলায় বিধান কী? যদি ধরে নেই ৬ নং ধারা অনুযায়ী নাম তালিকাভুক্তির মাধ্যমে দ্বিতীয় ও পরবর্তি প্রজন্ম তথা প্রবাসী সবাই বাংলাদেশের নাগরিক হবার যোগ্যতা অর্জন করবেন তাহলে ৭নং ধারার প্রয়োজনীয়তা কী?

৭নং ধারা অনুযায়ী যদি তৃতীয়-চতুর্থ প্রজন্ম নাগরিক হতে না পারেন। তাহলে তারা বিদেশী হিসেবেই ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে যাতায়াত করতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে তাদের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে জটিলতা এবং হয়রানির সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
আসলে প্রস্তাবিত বিলে উল্লেখিত বিধি-বিধানের কোন ব্যাখ্যা নেই। এটি বাস্তবায়িত হলে নানাভাবে প্রবাসীরা হয়রানির শিকার হবেন।

৪.
প্রবাসীরা বাংলাদেশের জন্মসূত্রে নাগরিক। এই ধারাবাহিকতায় তাদের সন্তানরাও বাংলাদেশের নাগরিক। দ্বৈত নাগরিকত্ব আইন দ্বারা প্রবাসীদের এ অধিকার তথা জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব এবং বংশসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকার রক্ষিত হয়েছে। অথচ নাগরিকত্ব আইনের ৫ নং ধারা অনুযায়ী নাম তালিকাভুক্ত না করলে দ্বিতীয় প্রজন্ম বাংলাদেশের নাগরিক হবেন না, এবং দ্বিতীয় প্রজন্ম বিদেশী নাগরিক হওয়ার পূর্বে বাংলাদেশের নাগরিক না হওয়ার কারণে তৃতীয় প্রজন্ম বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদনের যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না (৬নং ধারা অনুযায়ী)।

আইন করে জন্মসূত্রে-বংশসূত্রে বাংলাদেশের উত্তরাধিকারদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার কোন সুযোগ বাংলাদেশের সংবিধানে নেই।

সংবিধানের তৃতীয় বিভাগে উল্লেখিত মৌলিক অধিকার বিষয়ক অনুচ্ছেদ সংবিধান দ্বারা সংরক্ষিত। এটি পরিবর্তন-পরিবর্ধন-সংযোজন-বিয়োজন যোগ্য নয়। এমনকি সংবিধান সংশোধন বিষয়ে ১৪২ অনুচ্ছেদে উল্লেখ্য বিধানাবলীরও আওতামুক্ত।

সংবিধানের ২৭ নং ধারায় রয়েছে- সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।

ধারা ২৮ (১) উপধারায় রয়েছে- কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না।
সরকারী নিয়োগ-লাভে সুযোগের সমতা বিষয়ে ২৯ (২) ধারায় বলা হয়েছে- কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।

তাই প্রস্তাবিত আইনে বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(১) ধারা অনুযায়ী প্রবাসী নাগরিকদের সাথে বৈষম্যের অভিযোগ আনা যায়।

আমরা সুনির্দিষ্টভাবে প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব বিল থেকে প্রবাসীদের নাগরিকত্ব বিষয়ক ৬নং ধারা বাতিল, ৫নং ধারা থেকে নাম তালিকাভুক্তির বিধান বাতিল এবং ৫নং ধারা থেকে যদি তার পিতা বা মাতা এই আইন কার্যকর হইবার অব্যবহিত পূর্বে বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে থাকেন বিধানটি তুলে দিয়ে প্রবাসীদের বংশ-সূত্রে, জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকার সংরক্ষণ করার দাবি জানাচ্ছি।

নাগরিকত্ব বাতিল বিষয়ক ২০ নং ধারার একটি উপধারায় রয়েছে- বাংলাদেশের প্রতি তাহার আনুগত্য প্রত্যাহার করিয়াছেন মর্মে তথ্য পাওয়া গেলে নাগরিকত্ব বাতিল হবে। এ ধারা দ্বারাও প্রবাসীদের-নাগরিকদের হযরানির সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এখানে তথ্য পাওয়ার সূত্র, যাচাই-বাছাইসহ বিস্তারিত ব্যাখ্যা নেই।

ষষ্ট অধ্যায়ের শপথ বিষয়ক ধারা থেকে প্রবাসীদের আওতামুক্ত করা হোক। প্রবাসীরা জন্ম-বংশসূত্রে নাগিরক। পৃথক শপথ বা ঘোষণার প্রয়োজনীয় তা নেই।

এছাড়াও নাগরিকত্ব আইন থেকে বিতর্কিত ধারাসমূহ বিশেষ করে পিতা-মাতার অপরাধে সন্তানদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার যে বিধান রাখা হচ্ছে তা বাতিল করারও জোর দাবি জানাচ্ছি। অন্যথায় আমরা মনে করি এ আইন দ্বারা বিপুল সংখ্যক হয়রানির শিকার হবেন এবং একে রাজনৈতিকভাবে অপব্যবহারেরও সম্ভাবনা রয়েছে।

৫.
প্রবাসীরা দৈনন্দিন জীবন-সংগ্রামের পাশাপাশি তাদের সন্তানকে বাংলাদেশের সাথে সম্পৃক্ত রাখতে, নিজের কৃষ্টি-সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে রাখতে প্রতিনিয়ত লড়াই করেন। এখন মড়ার উপর খাড়ার ঘা‘য়ের মত এই নতুন প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব আইন। এটি বাস্তবায়িত হলে নানা জটিলতা তৈরী হবে, নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবার। প্রথম প্রজন্ম যারা বাংলাদেশে সম্পদ গড়ে তুলেছিলেন তাদের উত্তর পুরুষদের জন্য, তখন তাদেরকেও এই সম্পদের উত্তরাধিকার নিয়ে শংকায় পড়তে হবে। তারা নানা হয়রানির শিকার যেমন হবেন তেমনি অনেককেই বাধ্য হয়ে এই সম্পদ বিক্রয় করে দিতে হবে।

যুক্তরাজ্য প্রবাসীরা বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে যে অবদান রেখেছেন তা কোনভাবেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে নিছক জনমত তৈরীই নয় প্রবাসীরা নিজের বেতনের পুরো অংশ দিয়ে প্রাথমিক তহবিল গঠনেও ভূমিকা রেখেছেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় প্রবাসীরা কি এজন্য ভূমিকা রেখেছিলেন যে একদিন আইন করে তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক এবং তাদের সন্তানদের নাগরিকত্বহীন করা হবে?

আমরা মনে করি প্রস্তাবিত আইনটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এটি যাছাই-বাছাইয়ের এখনো অবকাশ রয়েছে। এর ভুল-ত্রুটিগুলো সংশোধন করে জন্মসূত্রে-বংশসূত্রে প্রবাসীদের নাগরিকত্ব অক্ষুন্ন রেখে বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকদের জন্য রক্ষিত পূর্ণ অধকিার সহ প্রবাসীদের নাগরিকত্ব বহাল রাখা হোক।

(গত ১ নভেম্বর ২০১৬, মঙ্গলবার বার্মিংহামে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে পঠিত মূল প্রবন্ধ। এটি সাপ্তাহিক সুরমা, সংখ্যা ২০০৩এ প্রকাশিত।)

সংবাদটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন সবার মাঝে

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on print
Print
Share on email
Email
Share on whatsapp
WhatsApp

কোন মন্তব্য নেই। আপনি প্রথম মন্তব্যটি করুন। on প্রস্তাবিত বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইন ২০১৬: নাগরিকত্ব এখন আর রক্ষণশীল নয়

আপনি কি ভাবছেন ? আপনার মতামত লিখুুন।

এই বিভগের আরো সংবাদ

সর্বশেষ