১২ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , শনিবার, ২৭ আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৮ রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি।
১২ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , শনিবার, ২৭ আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৮ রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি।

নেগেটিভ ভোটে যোগ-বিয়োগ পাল্টে যাবে

মাসুদ মজুমদার

17_1তিন সিটিতে ভোটারচিত্র কেমন হবে, ভোট দেয়ার পরিবেশ থাকবে তো, ভোট দেয়ার পর তা গোনা হবে কি না, ভোটারমনের চিন্তার সঠিক প্রতিফলন ঘটবে তো? ইত্যাকার চিন্তা নাগরিকদের ভাবনাকে আচ্ছন্ন করে রাখছে। এখনো প্রচারণায় বৈষম্যের অভিযোগ আমলে নেয়া হচ্ছে না। কোনো নাগরিক নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছে না। জমায়েত হলেই পুলিশ তাড়া করছে, জমায়েত শেষে ধরে নিয়ে যাচ্ছে কাউকে কাউকে। কেউ পুলিশ প্রটেকশনে, কেউ পুলিশের তাড়া খাচ্ছে- এমন পরিস্থিতি ’১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো অবস্থা সৃষ্টি করছে কি না, সেই শঙ্কা থেকে অনেকেই মুক্ত নন।

প্রধানমন্ত্রী অকপটে জানিয়ে দিয়েছেন- তিনি বিরোধী দলের মাজা বা কোমর ভেঙে দিয়েছেন। তারা আর সরকার নামানোর মুরোদ রাখে না বা দেখাবে না। কোনো সরকারকে নৈতিক ও গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কালো তালিকাভুক্ত করার জন্য জনগণ এই ধরনের একটি বাগাড়ম্বরকেই আমলে নিতে পারেন। বর্ষবরণের বৈশাখী অনুষ্ঠানে টিএসসিতে নারীর বস্ত্রহরণ, জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রীর শ্লীলতাহরণ, বুয়েটে শিক্ষকের সম্মানহরণ, হাজী দানেশে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে দুইজন নিহত হওয়ার ঘটনা, যুবলীগ নেতার অবৈধ বাড়ি ধসে কিংবা দেবে ডজনখানেক মানুষ লাশ হওয়ার মতো বিষয়গুলো আমলে নেয়ার দরকার হয় না। খুন-গুম, অপহরণের মতো এই পাপগুলো উপেক্ষিত হবে। বড়লোকের ছেলেপুলের কিছু দোষ যেমন থাকতে হয়, ক্ষমতার সুবিধাভোগীদেরও যেন কোনো পাপই পাপ নয়। সব পাপ মাফ হয়ে যায়।

এ সরকার স্থানীয় সরকারব্যবস্থা জোরদার করতে কখনো চায়নি। মেয়াদোত্তীর্ণ সিটি করপোরেশন নিয়ে তাদের হেঁয়ালিপনা সবার নজরে আছে। উপজেলায় কী কাণ্ড ঘটানো হয়েছিল কেউ ভুলে যায়নি। জেলা পরিষদগুলো দলের স্থানীয় নেতাদের পুনর্বাসনের জন্য সব ব্যবস্থা করা হলো। নির্বাচনের নামটা পর্যন্ত নিলো না। গাজিপুর, সিলেট ও রাজশাহীতে নির্বাচিত বিরোধী দলসমর্থিত মেয়রদের ফৌজদারি মামলায় জড়িয়ে পদচ্যুত করার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হচ্ছে। প্রশাসক দিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন চালানো হলো। সাদেক হোসেন খোকাকে সহ্য করতে না পেরে ঢাকা সিটিকে ভাগ করা হলো। জনগণ দাবি জানিয়েও ভোটাধিকার আদায় করতে পারেনি। এখন জাতীয় নির্বাচন দাবি করেও জনগণ হতাশ। তিন সিটিতে নির্বাচন নাগরিক স্বার্থে নয়, ক্ষমতার পাটাতন শক্ত রাখতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক রাজধানীর দখলি স্বত্বটা চাই। ভোটের আয়োজন সে জন্যই। মাজা ভেঙেই এই আয়োজন।

বিরোধী দলের মাজা বা কোমর ভেঙে দিয়ে সরকার অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে তিন সিটিতে নির্বাচন দিয়ে দৃষ্টি ফেরাতে সচেষ্ট। বিরোধী দলকে অপ্রস্তুত রেখে হামলা-মামলা, অপহরণ, গ্রেফতার ও গণতান্ত্রিক সব অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সিটি নির্বাচনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এটা যেন হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটতে দেয়া। অপ্রস্তুত বিরোধী দল, তার পরও জনগণের ওপর ভরসা করে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার প্রস্তুতি নিয়ে দেখছে- হেঁশেলের সব চাবি অন্যের হাতে গচ্ছিত রেখে অসহায় গৃহিণীকে রাঁধতে দেয়া হয়েছে। তারপরও বিরোধী দলকে চ্যালেঞ্জ নিতে দেখে সরকার বিপাকে পড়ে যায়। সরকারের ধারণা ছিল বিরোধী দল জেদ বহাল রাখতে গিয়ে সিটি নির্বাচন বর্জন করবে। সরকার একতরফা নির্বাচনে তিন সিটিতে জায়গা করে নিয়ে রাজধানী ও বন্দর নগরীকে কবজা করে রাখবে। আগেই উল্লেখ করেছি, বিরোধী দলসমর্থিত সিলেট, গাজীপুর ও রাজশাহীর মেয়রদের ইতোমধ্যে বারোটা বাজিয়ে দেয়া হয়েছে।

মাজাভাঙা বিরোধী দল নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণায় সরকার কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বিপাকে পড়ে যায়। এখন সরকারসমর্থিত প্রার্থীদের জিতিয়ে নেয়ার জন্য অন্য সব অনিয়ম মগজে নিতে হচ্ছে। এটা ঠিক, প্রার্থী নির্বাচনে সরকারি দল মুনশিয়ানা দেখাতে চেষ্টা করেছে বলে তাদের ধারণা। বিরোধী দল যাতে যোগ্য প্রার্থী দিতে না পারে, সেই পরিকল্পনা আগেই নেয়া আছে। ড. তুহিন মালিক ও মাহমুদুর রহমান মান্নাকে ল্যাং মেরে ঠ্যাং ভাঙার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে। বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের মাথার ওপর হুলিয়া ঝুলছে। তারপরও বিরোধী দল একজন হেভিওয়েট রাজনীতিবিদ, অভিজ্ঞ ও চেনাজানা মুখকে সামনে এনেছে। নতুন প্রজন্মের একজনকেও তুলে আনল।

যারা রাজনীতিতে জনমতের ভীতিতে বসবাস করে, তাদের নির্বাচনে কারসাজি করার প্রক্রিয়া শুরু হয় ভুয়া ভোটার করার মাধ্যমে। ভুয়া ও ভুতুড়ে ভোটাররা সরকারি আনুকূল্যে টোকাই হয়ে টাকার বিনিময়ে সিল মারে। জাল ভোটের হাট বসায়। যে নির্বাচন কমিশন আড়াই থেকে পাঁচ শতাংশ ভোটকে ৪০ শতাংশ দেখাতে পারে, অর্থহীন ও ভোটারবিহীন জাতীয় নির্বাচনকে বৈধতা দিয়ে কৃতার্থ হয়, যারা সাংবিধানিক প্রদত্ত ক্ষমতা দেখানোর মতো মেরুদণ্ডটাও খাড়া করে দেখাতে পারে না, তাদের কাছে পোলিং ও প্রিজাইডিং অফিসাররা নিরাপত্তা পাবেন কিভাবে! নিরাপত্তা দেয়া হবে ঝাড়–দার, পিয়ন, আয়া-বুয়া ধরনের নৈতিকভাবে দুর্বল, পোলিং ও প্রিজাইডিং কর্মকর্তাদের। স্বভাবতই ভোটকেন্দ্রে ক্ষমতার নৈরাজ্য ছাড়া আর কিছুই দেখা যাবে না। ক্ষমতা যার, পুলিশ তার। ভোটকেন্দ্রও তার। এখন মনে হচ্ছে, বিরোধী দল সব কেন্দ্রে এজেন্ট দিয়েও টিকাতে পারবে না। বাইরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দৃশ্যত নিরাপত্তাবলয় সৃষ্টি করবে। ভেতরে অসহায় ভোটারের টুঁ শব্দটি করার সুযোগও থাকবে না। ভোট চুরি নয়, ডাকাতি করলেও মাজা ভেঙে দেয়া বিরোধী দলের আর্তনাদ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। নির্বাচনের দায়িত্বে থাকবেন মূলত স্থানীয় স্কুল-কলেজের শিক্ষক, যারা ক্ষমতাধর বা পরাশক্তির পূজা ছাড়া আর কিছু বুঝবেন না। কিছু সরকারি কর্মকর্তা, তারা কেউ ঝুঁকি নিয়ে সততা দেখাতে যাবেন না। তখন নৈতিক শক্তির মৃত্যুর ঘটবে ভীতির কবলে।
ভোটের সংখ্যাতত্ত্ব অনুযায়ী, বিএনপি জোট স্বভাবতই দশ শতাংশ বেশি ভোট পাওয়ার কথা। কিন্তু ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার মতো নির্বিঘœ পরিস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিরোধী জোট ভোটকেন্দ্র পাহারা দেয়ার মতো অবস্থায়ও নেই, পুলিশ তা হতেও দেবে না। পুলিশের ছত্রছায়ায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ ক্যাডাররা দাপটের সাথে ক্ষমতা দেখাবে। বস্ত্রহরণের ভয়ে কেউ প্রতিবাদী হতে চাইবে না। অপর দিকে বিরোধী দলের সামনে থাকবে পুলিশভীতি, গ্রেফতার আতঙ্ক, মামলায় জড়িয়ে যাওয়ার ভয়। পুলিশ এই সুযোগে পুরনো মামলার অজ্ঞাত তালিকাকে জ্ঞাত করতে তৎপর। এতে বাণিজ্য হয়, সরকার খুশি থাকে। মিডিয়া দর্শক-স্রোতা ধরে রাখার জন্য নিরপেক্ষতার ভান করবে; কিন্তু পেশাদারিত্ব বিকিয়ে দেবে সরকারের নির্দেশনার দিকে। দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকেরা অনেক কথা বলবেন, তাতে গণতন্ত্রের মায়াকান্না শোনা যাবে- এই মুরোদহীন নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের তাতে কিছু আসবে-যাবে না।

শেষ পর্যন্ত লোকদেখানো ট্রাফিক পুলিশের মতো ক্ষমতাহীন করে সেনা মোতায়েনের প্রসঙ্গ উঠল। তারা হয়তো বাইরে শৃঙ্খলা রক্ষা করবে, ভেতরে কবরের নিস্তব্ধতা নেমে আসবে। এর পুরো সুযোগটা গ্রহণ করবে ভোটচোরেরা। তাতে ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিত হবে কিভাবে? আমাদের পর্যবেক্ষণে সিটি মেয়র পুরোহিত মাত্র। তার সম্মান আছে, ক্ষমতা নেই। ওয়াসা, ডেসা, রাজউক, টিএ্যান্ডটি, গণপূর্ত বিভাগ, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় টানাহেঁচড়া করে। কিছু টেন্ডার বিলিবণ্টন, ট্রেড লাইসেন্স বাণিজ্য এবং হোল্ডিং ট্যাক্স ভাগাভাগি ছাড়া তারা শুধু নগরভবন পাহারা দেন। মশা তাড়ানো, ড্রেনেজ সিস্টেম পাহারা দেয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার ক্ষেত্রেও সিটি করপোরেশন অসহায়। এ নির্বাচন তাই রাজনৈতিক প্রেস্টিজ রক্ষা করা ছাড়া আর কোনো কাজ দেয় না। এ কারণেই মেয়রপ্রার্থীরা যেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন এবং ভড়ং দেখাচ্ছেন, তার উল্লেখযোগ্য অংশই বোগাস।

সরকারের ভরসা শক্তির জোর। বিরোধী দলের ভরসা পরিবর্তনকামী মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের ইচ্ছা। ভোট দেয়ার পরিবেশ সৃষ্টি না হলে নাগরিকসমাজ বিরোধী দলের প্রতি সহমর্মিতা দেখাবে- ভোট দেয়ার ঝুঁকি নেবে না।
এবার কার্যত নেগেটিভ ভোটের জোয়ার বইবে। মানুষ সব ক্ষোভ-দুঃখ, ভোট ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের জবাব ব্যালটের মাধ্যমে দিতে চাইবে। নিরাপত্তাহীন জীবনের শোধ নিতে চাইবে, তাও ব্যালটের মাধ্যমে। জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে না পারার ক্ষোভটাও প্রকাশ করবে ব্যালটের মাধ্যমে। ভোটটা বিরোধী দলকে দেবে কি না, তারচেয়েও বড় হয়ে দেখা দেবে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানানোর দায় পূরণের। সরকার চাইবে ভোটাররা কেন্দ্রে কম যাক। বিরোধী দল চাইবে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটের জমজমাট হাট বসুক।

সরকারের ঔদ্ধত্য সব সীমা অতিক্রম করেছে। খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার মাধ্যমে তার বহিঃপ্রকাশ দ্বিতীয়বারও ঘটল। প্রধানমন্ত্রী আগের ঘটনাকে ‘নাটক’ বললেন। এ জাতির কপালে আরো কষ্ট আছে। একজন প্রার্থী মনে করেন, ভোটের বাক্স ভরাই আছে। ২৮ তারিখে সেগুলো গোনা হবে। ইসি সেটা ঘোষণা দেবেন মাত্র। সাঈদ খোকন যখন বলেন, হারার কোনো সুযোগ নেই, তাকে হারানোর সাধ্য কারো নেই। তখন কান কথায় মনোযোগ দিতেই হয়। জনগণ সব পারে না। সব পারেন সৃষ্টিকর্তা। জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে কি না, সেটা জানে সরকার ও ইসি। আর জানেন বিধাতা। তবে জনগণ ভোট দেয়ার সুযোগ পেলে সব যোগ-বিয়োগ পাল্টে যাবে।

সংবাদটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন সবার মাঝে

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on print
Print
Share on email
Email
Share on whatsapp
WhatsApp

কোন মন্তব্য নেই। আপনি প্রথম মন্তব্যটি করুন। on নেগেটিভ ভোটে যোগ-বিয়োগ পাল্টে যাবে

আপনি কি ভাবছেন ? আপনার মতামত লিখুুন।

এই বিভগের আরো সংবাদ

সর্বশেষ