২৯ মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , শুক্রবার, ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৮ রমজান, ১৪৪৫ হিজরি।
২৯ মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , শুক্রবার, ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৮ রমজান, ১৪৪৫ হিজরি।

কংগোর ডায়েরি: (দ্বিতীয় পর্ব)

দ্বিতীয় পর্ব:

দেখতে দেখতে আরো দু’সপ্তাহ কেটে গেল। এ সময়ে কংগোর সামাজিক ও রাজনৈতিক কিছু ঘটনা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে। সে সব ঘটনার কিছু কিছু আপনাদের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করবো।

এ দেশের সরকার প্রায় এক বছর যাবত অবৈধ ভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে আছে। ইলেকশান দিচ্ছে না। তাই প্রায়ই বিরোধি দল মিছিল মিটিং করে। এ ধরনের মিটিং প্রায় সব সময় ই সহিংসতায় রূপ নেয়। তখন পুলিশ নির্বিচারে লাঠি চার্জ করে ও গুলি চালায়। জ্বালাও, পোড়াও, ভাংচুর, লুটপাট ইত্যাদি তখন চলতে থাকে। আমাকে সিকিউরিটি কো-অর্ডিনেটর একদিন বললো – আজ গাড়ি অন্য পথে তোমাকে হোটেলে পৌঁছে দিবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম – কেন। সে বললো – আজ বিরোধী দলের জনসভা আছে। যে কোন মূহুর্তে সারা শহরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে। আমি তাকে বললাম – অসুবিধা নাই। আমি এ ধরনের সিচুয়েশনে অভ্যস্থ। মনে মনে চিন্তা করলাম – বাংলাদেশের সাথে এত মিল কিভাবে হয়? আমরা কি তাদের কে ফলো করছি। না কি তারা আমাদের কে ফলো করছে।

যাহোক এখানে ফর্মাল চাঁদাবাজি নেই। তবে আন অফিশিয়ালি পুলিশ নাকি চাঁদাবাজি করে। তা ও শুধু যানবাহন থেকে। কারন হলো তাদের বেতন খুবই কম। মাসে মাত্র ৭০ থেকে ৮০ ডলার। ইয়াং জেনারেশনের বড় অংশই উচ্ছন্নে যাচ্ছে বলে সবার ধারনা। তবে ড্রাগের প্রাদূর্ভাব বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম।

বেশির ভাগ মানুষই খুব নিরীহ এবং অতিথি পরায়ন। তাদের মধ্যে সামাজিক বন্ধন খুবই মজবুত। প্রত্যেকে প্রত্যেকের বিপদে আপদে এগিয়ে আসে। তারা সব সময় হাঁসি খুশি থাকতে পছন্দ করে। খুব অল্পতেই তারা সন্তুষ্ট। বৃদ্ধ মা-বাবার খুব খেদমত করে। রাজনীতি তে তাদের কোন আগ্রহ নেই। এটা আমি বলছি যারা এখন ৪০ বা তার উপরে বয়স। কিন্তু ইয়াং জেনারশন নাকি আস্তে আস্তে এ ট্রেডিশান থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এ জন্য তারা খুবই চিন্তিত।

একদিন অফিস থেকে আমাকে লং ড্রাইভে নেয়ার ব্যবস্থা করে। আমার অনুরোধে কোন গানম্যান ছাড়াই প্রায় চার ঘন্টা আমাকে নিয়ে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। অবশ্য শর্ত একটা ছিল। আমি কোথাও গাড়ি থেকে নামতে পারবো না। আমি তাতেই রাজি হয়ে গেলাম।

আমার সাথে যে ড্রাইভার ছিল, ওর নাম পাতু কুমার। সে ইংরেজি বুঝে, কিন্তু বলতে পারে কম। ভাংগা ভাংগা ইংরেজিতে সে আমাকে ধারা বিবরণী দিয়ে যাচ্ছিল। প্রথমে গেলাম ডাউন টাউনের দিকে। শহর থেকে প্রায় আট দশ মাইল দূরে। হায় হায় এত দেখি আরেক বাংলাদেশ। অনেকটা পুরান ঢাকা। রাস্তার দুই পাশে দোকান পাট। তবে সবই অস্থায়ী। ছোট ছোট টেবিলে নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিষ সাজিয়ে মহিলারা বিক্রি করছে। প্রতিটা টেবিলের উপরে বড় ছাতার আচ্ছাদন। অনেকটা বিচ আমব্রেলার মত। কিছুদূর পর পর চায়ের দোকান। সেখানে পৌঢ় ও বৃদ্ধ বয়সের পুরুষদের আড্ডা। ফুটপাথের প্রায় পুরাটাই দোকানদারদের দখলে। অনেক জায়গায় রাস্তার উপরও ওয়েল্ডিং করতে দেখেছি।

কিছুদূর পর এক জায়গায় প্রচুর ইয়াং ছেলে মেয়ের উপস্থিতি লক্ষ্য করলাম। কাছে পৌঁছার পর দেখি এটা একটা ক্লাব ঘর। এখানে প্রজেক্টরে বড় পর্দায় ওয়ার্ল্ড কাপ খেলা দেখাচ্ছে। অনেকে খেলা দেখা বাদ দিয়ে কেরাম খেলছে। অবাক হলাম দেখে কিছু কিছু বাড়ির সামনে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা কুতকুত ও মার্বেল খেলছে।

আসার পথে দেখলাম রাস্তার পাশে নাপিত ক্ষৌর কর্ম করছে। যার চুল কাটছে, তার হাতে একটা আয়না ধরিয়ে দিয়ে নাপিত একমনে তার কাজ করে যাচ্ছে। ছোট কালে আমরাও এ ভাবে পিড়ির উপর বসে চুল কাটাতাম। নাপিতের একটা ছবি তুলতে চাইলাম। সে দিবে না। কিছুক্ষন অপেক্ষা করে তার পুরো কাজটা দেখলাম। ছোট কালে আমাদের ঘাড়ের চুল উপড়ে ফেলার জন্য এক ধরনের মেশিন ব্যবহার করতো। আমি এটাকে বুল্ডোজার বলতাম। এটাতে প্রচুর সুড়সুড়ি লাগতো। এখানে নাপিত কে সেই বুল্ডোজার ও ব্যবহার করতে দেখলাম।

এখানে প্রত্যেক বাড়িতেই আম ও পেঁপে গাছ কমন। অনেক বাড়ির সামনে লেবু গাছ ও দেখলাম। আম গাছে এখন মুকুলে ভর্তি। মুকুলের রং গাড় খয়েরি। অনেক গাছে দেখলাম একই ডালে আম ও ধরে আছে, আবার মুকুল ও আছে। অনেক বাড়িতে নারিকেল ও কাঁঠাল গাছ দেখলাম। এখানে প্রচুর পাখি দেখা যায়। এর মধ্যে দোয়েল, গলা সাদা কাক, চড়ুই, শালিক, ঘুঘু, টুনটুনি, বক অন্যতম। ছোট ছোট গাছে টুনটুনির বাসা দেখতে অনেকটা বাবুই পাখির বাসার মত।

আমার হোটেলের কম্পাউন্ডের মধ্যে অনেক সুপারি গাছ। সুপারি পেঁকে মাটিতে পড়ে আছে। একদিন মালিকে জিজ্ঞেস করলাম সুপারিগুলো তারা কি করে। সে বললো- তারা এগুলো ফেলে দেয়। সুপারি গাছগুলো অর্নামেন্টাল হিসাবে লাগিয়েছে। আহারে, আমরা কত টাকা খরচ করে সুপারি কিনি, আর তারা এসব ফেলে দেয়।

গতদিন অফিস থেকে আসার পথে দেখি পথে এক মহিলা কাঁঠাল বিক্রি করছে। একটা মাঝারি সাইজের কাঁঠাল কিনে আনলাম। খুবই মিষ্টি এবং সুগন্ধি। কিন্তু এরা কাঁঠাল খায় না। এখানে অনেক ইন্ডিয়ান আছে। বিশেষ করে গুজরাটি। তারাই নাকি এই কাঁঠাল কিনে।

এখানকার সুপারস্টোরের বেশির ভাগের মালিক গুজরাটি। তাদের একটা বড় অংশ ইসমায়িলী সম্প্রদায়ের। আজকে বাজার করতে গেলাম। পুঁই শাক, ডাটার শাক, ও শষা কিনলাম। এ সবই লোকাল প্রোডাক্ট। খুবই ফ্রেস। দাম খুব বেশি না। প্রতি মুঠা প্রায় এক ডলার। নাগা/ বাতাসা মরিচ ও পেলাম। খেয়ে বুঝা যাবে স্বাদ কেমন।

এখানকার রাস্তায় সকালের দিকে মাঝারি ধরনের ট্রাফিক জ্যাম হয়। কিন্তু বিকেল বেলার জ্যাম ঢাকার মতই। গাড়ি চলতেই চায় না। গাড়ি থামলেই হঠাত করে কোত্থেকে একদল ফকির উদয় হয়। আপনি যদি একজনকে টাকা দেন, তবে আপনার খবর আছে। বাকিদের কে না দিলে তারা আপনার গাড়ি মুভ করতে দিবে না। গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি একদিন এই ভুল করেছিলাম। পরে ঠেকে শিখেছি। এখন আর তাদের দিকে তাকাই না। তারা কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করে চলে যায়।

এখানে রাস্তায় প্রচুর দামি গাড়ি চলতে দেখা যায়। তাছাড়া ইউ এন এর বিশাল বিশাল গাড়িতো আছেই। সাধারণ মানুষের জন্য যানবাহনের সংখ্যা খুবই কম। বাস খুব একটা দেখা যায় না। স্বল্প সংখ্যক মাইক্রোবাস দেখা যায়। এ ছাড়া ইয়েলো ক্যাব ও আছে। কিন্তু বিদেশিদের জন্য ইয়েলো ক্যাব ব্যবহার করা খুবই বিপদজনক। এদের বেশির ভাগই ছিনতাই কারী। এজন্য শুধু মাত্র রেজিস্ট্রার্ড কোম্পানীর গাড়ি ই বিদেশিরা ভাড়া করে। হোটেলগুলোতে এ ধরনের বিশ্বস্থ গাড়ির নাম্বার আছে। রাস্তা থেকে গাড়ি হায়ার করা ও নিরাপদ নয়। হোটেল থেকে এ জন্য সবসময় সাবধান করে দেয়া হয়। হোটেলের রিসেপশনে বললে তারা গাড়ি ডেকে দেয়। গাড়ি আসলে হোটেল কর্তৃপক্ষ গাড়ির ড্রাইভারের ছবি তুলে রাখে ও গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নাম্বার লিখে রাখে। হোটেল থেকে যাত্রী উঠানোর জন্য অবশ্য টেক্সিকে ভাড়ার চেয়ে ৫ ডলার বেশি দিতে হয়। আবার হোটেলে ড্রপ করলে ও ৫ ডলার বেশি দেতে হয়। এটাই এখানকার নিয়ম।

একটা খুব আশ্চর্য ব্যাপার হলো এখানকার রাস্তাঘাটে কোন কুকুর দেখা যায় না। মাঝে মাঝে দু একটা বিড়াল চোখে পড়ে। আমি যতটুকু ঘুরেছি, তাতে দেখলাম শহরের মধ্যে নির্দিষ্ট জায়গাতেই ময়লা ফেলতে। তবে ডাউন টাউনের অবস্থা খুব খারাপ। ময়লা, ড্রেনের পানি সব একাকার।

আজ এই পর্যন্তই। আবারো লেখার চেষ্টা করবো।

কিনশাসা, ২৯ জুন, ২০১৮

millatemustafa@yahoo.com

সংবাদটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন সবার মাঝে

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on print
Print
Share on email
Email
Share on whatsapp
WhatsApp

কোন মন্তব্য নেই। আপনি প্রথম মন্তব্যটি করুন। on কংগোর ডায়েরি: (দ্বিতীয় পর্ব)

আপনি কি ভাবছেন ? আপনার মতামত লিখুুন।

এই বিভগের আরো সংবাদ

সর্বশেষ