২৯ মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , শুক্রবার, ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৮ রমজান, ১৪৪৫ হিজরি।
২৯ মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , শুক্রবার, ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৮ রমজান, ১৪৪৫ হিজরি।

অবশেষে বৈধতা পেলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড: রুমিন ফারহানা

গতকাল সংসদে বসে এক পর্যায়ে আমার মনে হচ্ছিল আমি কি সংসদে আছি,  নাকি গলির মোড়ের কোনো চা দোকানে? সংসদে তখন পয়েন্ট অব অর্ডারে ধর্ষণ নিয়ে আলোচনা চলছিল। ধর্ষণ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য জনাব মুজিবুল হক চুন্নু। প্রকাশ্যে তিনি কোনোরকম রাখঢাক ছাড়া ধর্ষণে অভিযুক্তদের বিনা বিচারে হত্যা করার দাবি জানান। এরপর তাতে অংশ নেন একই পার্টির জনাব কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনি আরো খোলামেলা, আরো দৃঢ়ভাবে এই দাবি জানিয়ে বলেন, ‘এই মুহূর্তে সমাজকে ধর্ষণমুক্ত করতে হলে এনকাউন্টার মাস্ট। ধর্ষককে গুলি করে মারতে হবে। একমাত্র ওষুধ পুলিশ ধরার পর ধর্ষককে গুলি করে মেরে ফেলা।’ জনাব ফিরোজ রশীদ এর আগেও ২০১৬ এবং ২০১৯ সালে ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্তদের গুলি করে মেরে ফেলার দাওয়াই দিয়েছিলেন। এরপর আওয়ামী লীগের তোফায়েল আহমেদ তার বক্তৃতায় এই দুইজনকে সমর্থন করে বক্তব্য দেন।

সবকিছুর পর বাকি ছিল এটার একটা ধর্মীয় দ্যোতনা যুক্ত করা। সরকারি জোটের সঙ্গী তরিকত ফেডারেশনের সংসদ সদস্য নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী সেটা পূর্ণ করেছেন। ‘ফতোয়া’ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে বলছি, এদের (ধর্ষকদের) ক্রসফায়ার করলে কোনো অসুবিধা নাই।’
এই দেশের আইনপ্রণেতারা সংসদে দাঁড়িয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্ররোচনা দেন। জানি, সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদের কারণে এমন বক্তব্য নিয়ে তাদের আইনের মুখোমুখি করা যাবে না, কিন্তু সেটা করা না গেলেই কি সংসদে বলা যাবে যা ইচ্ছে তাই? সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেয়ার সময় তো আমরা বলেছিলাম, ‘আমি যে কর্তব্যভার গ্রহণ করিতে যাইতেছি তাহা আইন অনুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিবো’। তাহলে এত ভয়ঙ্কর বেআইনি এবং অসাংবিধানিক বক্তব্য কীভাবে দেন তারা?

আমি জানি এই রাষ্ট্রের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ এখনো বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডের পক্ষে। জনগণের চিন্তার সঙ্গে মিল রেখে কথা বলা রাজনীতিবিদদের এক ধরনের চর্চাও আছে। কিন্তু যে বিষয়ে জনগণের চিন্তার মতো করে কথা বলা মানুষের প্রাণ সংহার করে বেআইনিভাবে, যে বিষয়ে কথা বলা মানুষের সর্বজনীন মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, সে বিষয়ে কথা বলা সংসদ সদস্যদের জন্য চরম গর্হিত অপরাধ। পপুলিজম এভাবেই রাষ্ট্রের জন্য চরম ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়।

বিশ্বের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কখনো হত্যাকারীদের উদ্দেশ্য সফল করেনি। ১৯৭৬-১৯৮৩ সময়কালে আর্জেন্টিনার কয়েকজন সামরিক শাসক বিরোধী মতকে দমন করার নামে অন্তত ১৫ হাজার মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করেছিল। যাদের মধ্যে ছিল বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী, মানবাধিকার কর্মী, শ্রমিক নেতা, সাংবাদিক, এমনকি ধর্মগুরু। একই কারণে চিলির কুখ্যাত শাসক অগাস্ট পিনোশে হত্যা করে পাঁচ হাজারের মতো বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে। কিন্তু কেউই বিরোধী মত বা দলকে নিঃশেষ করে ফেলতে সমর্থ হয়নি।

সামপ্রতিককালে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সবচেয়ে বেশি হচ্ছে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে। সরকারের ৫টি সংস্থার রিপোর্টে নাম আসা বদি পরিবার থাকবেন সংসদে আর সরকার বলবে জিরো টলারেন্স। নিরাপদে থাকবেন রাঘববোয়াল আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হবে কিছু চুনোপুঁটি। কিন্তু ফিলিপিন্সে সেটা হচ্ছে না। রদ্রিগো দুতার্তের সরকার মাদকের সঙ্গে যুক্ত সব রকম মানুষকে ধরতে পারলেই হত্যা করছে। ২০১৬-এর মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়ে ২০১৯-এর শুরুর মধ্যেই মাত্র আড়াই বছরে বিনা বিচারে হত্যার সংখ্যা বেসরকারি হিসাবে ২০ হাজারের বেশি। এই ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞও ফিলিপিন্সের মাদক সমস্যার সমাধান করতে পারেনি।

ধর্ষণ নিঃসন্দেহে এক বীভৎস ফৌজদারি অপরাধ। শুধু ভিকটিম না, তার পরিবার এবং সমাজকেও ধ্বংস করে এই অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি বিনা প্রতিবাদে মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। কিন্তু সেই দণ্ড হতে হবে দেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা মেনে। আইন প্রণয়ন সংসদ সদস্যদের মূল কাজ। তারা চাইলে যেকোনো সময় আইন পরিবর্তন করে ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড করতে পারে। বিচার প্রক্রিয়ায় যদি কোনো ত্রুটি থাকে সেটা নিয়েও সংসদে আলাপ-আলোচনা হতে পারে। সংশোধনের কাজ শুরু করা যেতে পারে। কিন্তু সংসদে দাঁড়িয়ে একজন সংসদ সদস্য যখন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে ন্যায্যতা দেন তখন দেশে আইনের শাসন বা বিচার ব্যবস্থা বলে আর কিছু থাকে না।

এই দেশে ইদানীং এক ব্যাধি শুরু হয়েছে- যাই ঘটুক না কেন অনেকেই মনে করতে শুরু করেছে কয়েকজন মানুষকে ধরে খুন করে ফেললে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। গত অধিবেশনেই পিয়াজের উচ্চমূল্য নিয়ে যখন সংসদে কথা হচ্ছিল, তখনো জনাব মুজিবুল হক চুন্নু পিয়াজ কারসাজির সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে বিনা বিচারে হত্যার দাওয়াই দিয়েছিলেন। সমাজের একেবারে অর্ধশিক্ষিত মানুষের এই ধরনের প্রবণতা তাও সহ্য করা যায়, কিন্তু একটা দেশের সংসদের ভেতরে যখন এই ধরনের দাবি তোলা হয় তখন সেটা এই রাষ্ট্রের একটা মূলস্তম্ভ আইনসভা সম্পর্কেই গুরুতর প্রশ্ন তুলে দেয়।

গতকালের সংসদের আলোচনায় বিনা বিচারে হত্যার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বিচার ব্যবস্থার নানা ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন জনাব ফিরোজ রশীদ। এমন এক সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি এই কথা বলেছেন, যেখানে ক্ষমতাসীন দলটি গত ১১ বছর ধরে নিরঙ্কুশভাবে টানা ক্ষমতায়। আইনের বা পদ্ধতিগত কোনো সমস্যা থাকলে সেটা সংশোধন করার জন্য আইন তো বটেই, সংবিধান সংশোধন করার ক্ষমতাও এই সরকারের হাতে ছিল, আছে। কিন্তু সেসবের জন্য সরকারকে দায়ী না করে তথাকথিত বিরোধী দলের সদস্যরা বরং সরকারকে দায়মুক্তি দেয়ার চেষ্টা করছেন। ২০১৪ সালের তথাকথিত নির্বাচনের পর থেকে এটাই সংসদের এক ধরনের প্রবণতা।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যদি কোনো সমস্যা সত্যি সত্যি স্থায়ী সমাধান করতো তবুও কি এটা সমর্থনযোগ্য? কোনোভাবেই না। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড একটা রাষ্ট্রের একেবারে মৌলিক চেতনার পরিপন্থি। এই রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি বলে ন্যায়বিচার পাবার অধিকারী। সেই ন্যায়বিচারে তার এমনকি মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্র কোনো মানুষকে বিনা বিচারে খুন করার অধিকার রাখে না। কথাগুলোকে কেউ কেউ কেতাবি কথা বলতে পারেন, কিন্তু একটা রাষ্ট্র গড়ার ন্যূনতম পদক্ষেপের মধ্যে এটা একটা।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমাজের অনেকেই মেনে নেন। ২০১৮ সালে এবং এ বছর এখন পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে একজনের বেশি মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করা হচ্ছে, কিন্তু কেউ উচ্চবাচ্য করছে না তেমন। কিন্তু ভয়ঙ্কর আশঙ্কার ব্যাপার, মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং নাগরিক সমাজের কিছু সদস্য এক সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে খুব জোর গলায় কথা বলতেন, এখন তারা আর কথা বলেন না ম্রিয়মাণ গলাতেও চুপ থাকেন।

রাষ্ট্র অন্তর্গতভাবেই নিপীড়ক বলপ্রয়োগকারী সত্তা। নাগরিকদের খুব গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হচ্ছে সেই সত্তাকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে তাকে সংবিধান এবং আইনের চৌহদ্দির মধ্যে রাখা। এমনকি কোনো পরিস্থিতিতে নাগরিকরা যদি রাষ্ট্রকে আরো নিপীড়ক হতে প্ররোচনাও দেয় তাহলেও রাজনীতিবিদ এবং আইনপ্রণেতাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য সেটায় বাধা দেয়া। পরিহাসের ব্যাপার হলো বিচারবহির্ভূত হত্যার এই মহামারিতে সেটা বন্ধের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংসদে প্রস্তাব এনে সরকারকে চাপ দেয়া দূরেই থাকুক, সংসদ সদস্যরা সেটার প্ররোচনা দেন। এভাবেই একটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা ভেঙে যায় পুরোপুরি, হয়ে ওঠে সম্রাট শাসিত মধ্যযুগীয় রাজ্য। (সৌজন্যে- মানবজমিন)

লেখক: সংসদ সদস্য
(১৫ই জানুয়ারি, ২০২০, ঢাকা )

সংবাদটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন সবার মাঝে

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on print
Print
Share on email
Email
Share on whatsapp
WhatsApp

কোন মন্তব্য নেই। আপনি প্রথম মন্তব্যটি করুন। on অবশেষে বৈধতা পেলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড: রুমিন ফারহানা

আপনি কি ভাবছেন ? আপনার মতামত লিখুুন।

এই বিভগের আরো সংবাদ

সর্বশেষ